কুম বললে, “সুর বাঁধা নেই।”
“তোমার নিজের মনেরই সুর বাঁধা নেই, তাই বলো না কেন?”
কথাটার সত্যতায় কুমুর মনে তখনই ঘা লাগল; “যন্ত্রটা ঠিক করে রাখি, তোমাকে আর-একদিন শোনাব।”
“কবে শোনাবে ঠিক করে বলো। কাল?”
“আচ্ছা, কাল।”
“সন্ধেবেলায় আপিস থেকে ফিরে এলে?”
“হাঁ, তাই হবে।”
“এসরাজটা পেয়ে খুব খুশি হয়েছ?”
“খুব খুশি হয়েছি।”
শালের ভিতর থেকে একটা চামড়ার কেস বের করে মধুসূদন বললে, “তোমার জন্যে যে মুক্তার মালা কিনে এনেছি, এটা পেয়ে ততখানিই খুশি হবে না?”
এমনতরো মুশকিলের প্রশ্ন কেন জিজ্ঞাসা করা? কুমু চুপ করে এসরাজের ছড়িটা নাড়াচাড়া করতে লাগল।
“বুঝেছি, দরখাস্ত নামঞ্জুর।”
কুমু কথাটা ঠিক বুঝলে না।
মধুসূদন বললে, “তোমার বুকের কাছে আমার অন্তরের এই দরখাস্তটি লটকিয়ে দেব ইচ্ছে ছিল– কিন্তু তার আগেই ডিস্মিস্।”
কুমুর সামনে মেজের উপর গয়নাটা রইল খোলা। দুজনে কেউ একটিও কথা বললে না। থেকে থেকে কুমু যেরকম স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে যায়, তেমনি হয়ে রইল। একটু পরে যেন সচেতন হয়ে মালাটা তুলে নিয়ে গলায় পরলে, আর মধুসূদনকে প্রণাম করলে। বললে, “তুমি আমার বাজনা শুনবে?”
মধুসূদন বললে, “হাঁ শুনব।”
“এখনই শোনাব” বলে এসরাজের সুর বাঁধলে। কেদারায় আলাপ আরম্ভ করলে; ভুলে গেল ঘরে কেউ আছে, কেদারা থেকে পৌঁছোল ছায়ানটে । যে গানটি সে ভালোবাসে সেই ধরল, “ঠাড়ি রহো মেরে আঁখনকে আগে।” সুরের আকাশে রঙিন ছায়া ফেলে এল সেই অপরূপ আবির্ভাব, যাকে কুমু গানে পেয়েছে, প্রাণে পেয়েছে, কেবল চোখে পাবার তৃষ্ণা নিয়ে যার জন্যে মিনতি চিরদিন রয়ে গেল– “ঠাড়ি রহো মেরে আঁখনকে আগে।”
মধুসূদন সংগীতের রস বোঝে না, কিন্তু কুমুর বিশ্ববিস্মৃত মুখের উপর যে সুর খেলছিল, এসরাজের পর্দায় পর্দায় কুমুর আঙুল-ছোঁয়ার যে ছন্দ নেচে উঠছিল তাই তার বুকে দোল দিলে, মনে হতে লাগল ওকে যেন কে বরদান করছে। আনমনে বাজাতে বাজাতে কুমু হঠাৎ এক সময়ে দেখতে পেল মধুসূদন তার মুখের উপর একদৃষ্টে চেয়ে, অমনি হাত গেল থেমে; লজ্জা এল, বাজনা বন্ধ করে দিলে।
মধুসূদনের মন দাক্ষিণ্যে উদ্বেল হয়ে উঠল, বললে, “বড়োবউ, তুমি কি চাও বলো।” কুমু যদি বলত, কিছুদিন দাদার সেবা করতে চাই, মধুসূদন তাতেও রাজি হতে পারত; কেননা আজ কুমুর গীতমুগ্ধ মুখের দিকে কেবলই চেয়ে চেয়ে সে নিজেকে বলছিল, “এই তো আমার ঘরে এসেছে, এ কী আশ্চর্য সত্য!”
কুমু এসরাজ মাটিতে রেখে ছড়ি ফেলে চুপ করে রইল।
মধুসূদন আর-একবার অনুনয় করে বললে, “বড়োবউ, তুমি আমার কাছে কিছু চাও। যা চাও তাই পাবে।”
কুমু বললে, “মুরলী বেয়ারাকে একখানা শীতের কাপড় দিতে চাই।”
কুমু যদি বলত কিছু চাই নে, সেও ছিল ভালো, কিন্তু মুরলী বেহারার জন্যে গায়ের কম্বল! যে দিতে পারে মাথার মুকুট, তার কাছে চাওয়া জুতোর ফিতে!
মধুসূদন অবাক। রাগ হল বেহারাটার উপর। বললে, “লক্ষ্মীছাড়া মুরলী বুঝি তোমাকে বিরক্ত করেছে?”
“না, আমি আপনিই ওকে একটা আলোয়ান দিতে গেলুম,ও নিল না। তুমি যদি হুকুম কর তবে সাহস করে নেবে।”
মধুসূদন স্তব্ধ হয়ে রইল। খানিক পরে বললে, “ভিক্ষে দিতে চাও! আচ্ছা দেখি, কই তোমার আলোয়ান?”
কুমু তার সেই অনেক দিনের পরা বাদামি রঙের আলোয়ান নিয়ে এল। মধুসূদন সেটা নিয়ে নিজের গায়ে জড়াল। টিপায়ের উপরকার ছোটো ঘণ্টা বাজিয়ে দিতে একজন বুড়ি দাসী এল; তাকে বললে, ” মুরলী বেহারাকে ডেকে দাও।”
মুরলী এসে হাত জোড় করে দাঁড়াল; শীতে ও ভয়ে তার জোড়া হাত কাঁপছে।
“তোমার মাজি তোমাকে বকশিশ দিয়েছেন,” বলে মধুসূদন পকেট-কেস থেকে একশো টাকার একটা নোট বের করে তার ভাঁজ খুলে সেটা দিলে কুমুর হাতে। এরকম অকারণে অযাচিত দান মধুসূদনের দ্বারা জীবনে কখনো ঘটে নি। অসম্ভব ব্যাপারে মুরলী বেহারার ভয় আরো বেড়ে উঠল, দ্বিধাকম্পিত স্বরে বললে, “হুজুর–”
“হুজুর কী রে বেটা! বোকা, নে তোর মায়ের হাত থেকে। এই টাকা দিয়ে যত খুশি গরম কাপড় কিনে নিস।”
ব্যাপারটা এইখানে শেষ হল– সেইসঙ্গে সেদিনকার আর-সমস্তই যেন শেষ হয়ে গেল। যে স্রোতে কুমুর মন ভেসেছিল সে গেল হঠাৎ বন্ধ হয়ে, মধুসূদনের মনে আত্মত্যাগের যে ঢেউ চিত্তসংকীর্ণতার কূল ছাপিয়ে উঠেছিল তাও সামান্য বেহারার জন্য তুচ্ছ প্রার্থনায় ঠেকে গিয়ে আবার তলায় গেল নেমে। এর পরে সহজে কথাবার্তা কওয়া দুই পক্ষেই অসাধ্য। আজ সন্ধের সময় সেই তালুক-কেনা ব্যাপার নিয়ে লোক এসে বাইরের ঘরে অপেক্ষা করছে, এ কথাটা মধুসূদনের মনেই ছিল না। এতক্ষণ পরে চমকে উঠে ধিক্কার হল নিজের উপরে। উঠে দাঁড়িয়ে বললে, “কাজ আছে, আসি।” দ্রুত চলে গেল।
পথের মধ্যে শ্যামাসুন্দরী ঘরের সামনে এসে বেশ প্রকাশ্য কণ্ঠস্বরেই বললে, “ঘরে আছ?”
শ্যামসুন্দরী আজ খায় নি; একটা র৻াপার মুড়ি দিয়ে মেজেয় মাদুরের উপর অবসন্ন ভাবে শুয়েছিল। মধুসূদনের ডাক শুনে তাড়াতাড়ি দরজার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলে, “কী ঠাকুরপো?”
“পান দিলে না আমাকে?”
৪৪
বাইরে অন্ধকারে দরজার আড়ালে একটি মানুষ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল– হাবলু। কম সাহস না। মধুসূদনকে যমের মতো ভয় করে, তবু ছিল কাঠের পুতুলের মতো স্তব্ধ হয়ে। সেদিন মধুসূদনের কাছে তাড়া খাওয়ার পর থেকে জ্যাঠাইমার কাছে আসবার সুবিধে হয় নি, মনের ভিতর ছট্ফট্ করেছে। আজ এই সন্ধ্যাবেলায় আসা নিরাপদ ছিল না। কিন্তু ওকে বিছানায় শুইয়ে রেখে মা যখন ঘরকন্নার কাজে চলে গেছে এমন সময় কানে এল এসরাজের সুর। কী বাজছে জানত না, কে বাজাচ্ছে বুঝতে পারে নি, জ্যাঠাইমার ঘর থেকে আসছে এটা নিশ্চিত; জ্যাঠামশায় সেখানে নেই এই তার বিশ্বাস, কেননা, তাঁর সামনে কেউ বাজনা বাজাতে সাহস করবে এ কথা সে মনেই করতে পারে না। উপরের তলায় দরজার কাছে এসে জ্যাঠামশায়ের জুতোজোড়া দেখেই পালাবার উপক্রম করলে। কিন্তু যখন বাইরে থেকে চোখে পড়ল ওর জ্যাঠাইমা নিজে বাজাচ্ছেন, তখন কিছুতেই পালাতে পা সরল না। দরজার আড়ালে লুকিয়ে শুনতে লেগেছে। প্রথম থেকেই জ্যাঠাইমাকে ও জানে আশ্চর্য, আজ বিস্ময়ের অন্ত নেই। মধুসূদন চলে যেতেই মনের উচ্ছ্বাস আর ধরে রাখতে পারলে না– ঘরে ঢুকেই কুমুর কোলে গিয়ে বসে গলা জড়িয়ে ধরে কানের কাছে বললে, “জ্যাঠাইমা।”