কুমু তাকে বুকে চেপে ধরে বললে, “এ কী, তোমার হাত যে ঠাণ্ডা! বাদলার হাওয়া লাগিয়েছ বুঝি?”
হাবলু কোনো উত্তর করলে না, ভয় পেয়ে গেল। ভাবলে জ্যাঠাইমা এখনই বুঝি বিছানায় শুতে পাঠিয়ে দেবে। কুমু তাকে শালের মধ্যে ঢেকে নিয়ে নিজের দেহের তাপে গরম করে বললে, “এখনো শুতে যাও নি গোপাল?”
“তোমার বাজনা শুনতে এসেছিলুম। কেমন করে বাজাতে পারলে জ্যাঠাইমা?”
“তুমি যখন শিখবে তুমিও পারবে।”
“আমাকে শিখিয়ে দেবে?”
এমন সময় মোতির মা ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকেই বলে উঠল, “এই বুঝি দস্যি, এখানে লুকিয়ে বসে! আমি ওকে সাতরাজ্যি খুঁজে বেড়াচ্ছি। এ দিকে সন্ধ্যাবেলায় ঘরের বাইরে দু পা চলতে গা ছম্ ছম্ করে, জ্যাঠাইমার কাছে আসবার সময় ভয়ডর থাকে না। চল্ শুতে চল্।”
হাবলু কুমুকে আঁকড়ে ধরে রইল।
কুমু বললে, “আহা, থাক্-না আর-একটু।”
“এমন করে সাহস বেড়ে গেলে শেষকালে বিপদে পড়বে। ওকে শুইয়ে আমি এখনই আসছি।”
কুমুর বড়ো ইচ্ছে হল হাবলুকে কিছু দেয়, খাবার কিম্বা খেলার জিনিস। কিন্তু দেবার মতো কিছু নেই, তাই ওকে চুমো খেয়ে বললে, “আজ শুতে যাও, লক্ষ্মী ছেলে, কাল দুপুরবেলা তোমাকে বাজনা শোনাব।”
হাবলু করুণ মুখে উঠে মায়ের সঙ্গে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পরেই মোতির মা ফিরে এল। নবীনের ষড়যন্ত্রের কী ফল হল তাই জানবার জন্যে মন অস্থির হয়ে আছে। কুমুর কাছে বসেই চোখে পড়ল, তার হাতে সেই নীলার আংটি। বুঝলে যে কাজ হয়েছে। কথাটা উত্থাপন করবার উপলক্ষ স্বরূপ বললে, “দিদি, তোমার এই বাজনাটা পেলে কেমন করে?”
কুমু বললে, “দাদা পাঠিয়ে দিয়েছেন।”
“বড়োঠাকুর তোমাকে এনে দিলেন বুঝি?”
কমু সংক্ষেপে বললে, “হাঁ।”
মোতির মা কুমুর মুখের দিকে তাকিয়ে উল্লাস বা বিস্ময়ের চিহ্ন খুঁজে পেলে না।
“তোমার দাদার কথা কিছু বললেন কি?”
“না।”
“পরশু তিনি তো আসবেন, তাঁর কাছে তোমার যাবার কথা উঠল না?”
“না, দাদার কোনো কথা হয় নি।”
“তুমি নিজেই চাইলে না কেন দিদি?”
“আমি ওঁর কাছে আর যা-কিছু চাই নে কেন, এটা পারব না।”
“তোমার চাবার দরকার হবে না, তুমি অমনিই ওঁর কাছে চলে যেয়ো। বড়োঠাকুর কিছুই বলবেন না।”
মোতির মা এখনো একটা কথা সম্পূর্ণ বুঝতে পারে নি যে, মধুসূদনের অনুকূলতা কুমুর পক্ষে সংকট হয়ে উঠেছে; এর বদলে মধুসূদন যা চায় তা ইচ্ছে করলেও কুমু দিতে পারে না। ওর হৃদয় হয়ে গেছে দেউলে। এইজন্যেই মধূসূদনের কাছে দান গ্রহণ করে ঋণ বাড়াতে এত সংকোচ। কুমুর এমনও মনে হয়েছে যে, দাদা যদি আর কিছুদিন দেরি করে আসে তো সেও ভালো।
একটু অপেক্ষা করে থেকে মোতির মা বললে, “আজ মনে হল বড়োঠাকুরের মন যেন প্রসন্ন।”
সংশয়ব্যাকুল চোখে কুমু মোতির মার মুখে তাকিয়ে বললে, “এ প্রসন্নতা কেন ঠিক বুঝতে পারি নে, তাই আমার ভয় হয়; কী করতে হবে ভেবে পাই নে।”
কুমুর চিবুক ধরে মোতির মা বললে, “কিছুই করতে হবে না; এটুকু বুঝতে পারছ না, এতদিন উনি কেবল কারবার করে এসেছেন, তোমার মতো মেয়েকে কোনোদিন দেখেন নি। একটু একটু করে যতই চিনছেন ততই তোমার আদর বাড়ছে।”
“বেশি দেখলে বেশি চিনবেন, এমন কিছুই আমার মধ্যে নেই ভাই। আমি নিজেই দেখতে পাচ্ছি আমার ভিতরটা শূন্য। সেই ফাঁকটাই দিনে দিনে ধরা পড়বে। সেইজন্যেই হঠাৎ যখন দেখি উনি খুশি হয়েছেন, আমার মনে হয় উনি বুঝি ঠকেছেন। যেই সেটা ফাঁস হবে সে-ই আরো রেগে উঠবেন। সেই রাগটাই যে সত্য, তাই তাকে আমি তেমন ভয় করি নে।”
“তোমার দাম তুমি কী জান দিদি! যেদিন এদের বাড়িতে এসেছ, সেইদিনই তোমার পক্ষ থেকে যা দেওয়া হল, এরা সবাই মিলে তা শুধতে পারবে না। আমার কর্তাটি তো একেবারে মরিয়া, তোমার জন্যে সাগর লঙ্ঘন না করতে পারলে স্থির থাকতে পারছেন না। আমি যদি তোমাকে না ভালোবাসতুম তবে এই নিয়ে ওর সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়ে যেত।”
কুমু হাসলে, বললে, “কত ভাগ্যে এমন দেবর পেয়েছি।”
“আর তোমার এই জা-টি বুঝি ভাগ্যস্থানের রাহু না কেতু।”
“তোমাদের একজনের নাম করলে আর-একজনের নাম করবার দরকার হয় না।”
মোতির মা ডান হাত দিয়ে কুমুর গলা জড়িয়ে ধরে বললে, “আমার একটা অনুরোধ আছে তোমার কাছে।”
“কী বলো।”
“আমার সঙ্গে তুমি “মনের কথা’ পাতাও!”
“সে বেশ কথা, ভাই! প্রথম থেকে মনে মনে পাতানো হয়েই গেছে।”
“তা হলে আমার কাছে কিছু চেপে রেখো না। আজ তুমি অমন মুখটি করে কেন আছ কিছুই বুঝতে পারছি নে।”
খানিকক্ষণ মোতির মার মুখের দিকে চেয়ে থেকে কুমু বললে, “ঠিক কথা বলব? নিজেকে আমার কেমন ভয় করছে।”
“সে কী কথা! নিজেকে কিসের ভয়?”
“আমি এতদিন নিজেকে যা মনে করতুম আজ হঠাৎ দেখছি তা নই। মনের মধ্যে সমস্ত গুছিয়ে নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েই এসেছিলুম। দাদারা যখন দ্বিধা করেছেন, আমি জোর করেই নতুন পথে পা বাড়িয়েছি। কিন্তু যে মানুষটা ভরসা করে বেরোল তাকে আজ কোথাও দেখতে পাচ্ছি নে।”
“তুমি ভালোবাসতে পারছ না। আচ্ছা, আমার কাছে লুকিয়ো না, সত্যি করে বলো, কাউকে কি ভালোবেসেছ? ভালোবাসা কাকে বলে তুমি কি জান?”
“যদি বলি জানি, তুমি হাসবে। সূর্য ওঠবার আগে যেমন আলো হয় আমার সমস্ত আকাশ ভরে ভালোবাসা তেমনি করেই জেগেছিল। কেবলই মনে হয়েছে সূর্য উঠল বলে। সেই সূর্যোদয়ের কল্পনা মাথায় করেই আমি বেরিয়েছি, তীর্থের জল নিয়ে– ফুলের সাজি সাজিয়ে। যে দেবতাকে এতদিন সমস্ত মন দিয়ে মেনে এসেছি, মনে হয়েছে তাঁর উৎসাহ পেলুম। যেমন করে অভিসারে বেরোয় তেমনি করেই বেরিয়েছি। অন্ধকার রাত্রিকে অন্ধকার বলে মনেই হয় নি, আজ আলোতে চোখ মেলে অন্তরেই বা কী দেখলুম, বাইরেই বা কী দেখছি! এখন বছরের পর বছর মূহূর্তের পর মূহূর্ত কাটবে কী করে?