যোগাযোগ

বৃষ্টি থেমে গেছে, কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ বাগানের কোণে এক প্রাচীন সিসু গাছের উপরে আকাশে উঠে আর্দ্র পৃথিবীকে বিহ্বল করে দিয়েছে। হাওয়াটা ঠাণ্ডা, মধুসূদনের দেহটা বিছানার ভিতরে একটা গরম কোমল স্পর্শের জন্যে দাবি জানাতে আরম্ভ করেছে। নীল পেনসিলটা চেপে ধরে খাতাপত্রের উপর সে ঝুঁকে পড়ল কিন্তু মনের গভীর আকাশে একটা কথা ক্ষীণ অথচ স্পষ্ট আওয়াজে বাজছে, “বউরানী হয়তো এতক্ষণ জেগে বসে আছেন।”

মধুসূদন পণ করেছিল, একটা বিশেষ কাজ আজ রাত্রের মধ্যেই শেষ করে রাখবে। সেটা কাল সকালের মধ্যে সারতে পারলে যে খুব বেশি অসুবিধা হত তা নয়। কিন্তু পণ রক্ষা করা ওর ব্যাবসায়ের ধর্মনীতি। তার থেকে কোনো কারণে যদি ভ্রষ্ট হয় তবে নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না। এতদিন ধর্মকে খুব কঠিনভাবেই রক্ষা করেছে। তাঁর পুরস্কারও পেয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু ইদানীং দিনের মধুসূদনের সঙ্গে রাত্রের মধুসূদনের সুরের কিছু কিছু তফাত ঘটে আসছে– এক বীণায় দুই তারের মতো। যে দৃঢ় পণ করে ডেস্কের উপর ও ঝুঁকে পড়ে বসেছিল– রাত্রি যখন গভীর হয়ে এল, সেই পণের কোন্‌ একটা ফাঁকের ভিতর দিয়ে একটা উক্তি ভ্রমরের মতো ভন্‌ ভন্‌ করতে শুরু করলে, “বউরানী হয়তো জেগে বসে আছেন।”

উঠে পড়ল। বাতি না নিভিয়ে খাতাপত্র যেমন ছিল তেমনি ভাবেই রেখে চলল শোবার ঘরের দিকে। অন্তঃপুরে আঙিনা-ঘেরা যে বারান্দা দিয়ে তেতালার ঘরে যেতে হয় সেই বারান্দায় রেলিঙের ধারে শ্যামাসুন্দরী মেজের উপর বসে। চাঁদ তখন মধ্য-আকাশে, তার আলো এসে তাকে ঘিরেছে। তাকে দেখাচ্ছে যেন কোন্‌ এক গল্পের বইয়ের ছবির মতো। অর্থাৎ সে যেন প্রতিদিনের মানুষ নয়, অতিনিকটের অতিপরিচয়ের কঠোর আবরণ থেকে যেন একটা দূরত্বের মধ্যে বেরিয়ে এসেছে। সে জানত মধুসূদন এই পথ দিয়েই শোবার ঘরে যায়– সেই যাওয়ার দৃশ্যটা ওর কাছে অতি তীব্র বেদনার, সেইজন্যেই তার আকর্ষণটা এত প্রবল। কিন্তু শুধু হৃদয়টাকে ব্যর্থ বেদনায় বিদ্ধ করবার পাগলামিই যে এই প্রতীক্ষার মধ্যে আছে তা নয়, এর মধ্যে একটা প্রত্যাশাও আছে– যদি ক্ষণকালের মধ্যে একটা কিছু ঘটে যায়; অসম্ভব কখন সম্ভব হয়ে যাবে এই আশায় পথের ধারে জেগে থাকা।

মধুসূদন ওর দিকে একবার কটাক্ষ করে উপরে চলে গেল। শ্যামাসুন্দরী নিজের ভাগ্যের উপর রাগ করে রেলিং শক্ত করে ধরে তার উপরে মাথা ঠুকতে লাগল।

শোবার ঘরে গিয়ে মধুসূদন দেখে যে কুমু জেগে বসে নেই। ঘর অন্ধকার, নাবার ঘরের খোলা দরজা দিয়ে অল্প একটু আলো আসছে। মধুসূদন একবার ভাবল ফিরে চলে যাই, কিন্তু পারল না। গ্যাসের আলোটা জ্বালিয়ে দিলে। কুমু বিছানার মধ্যে মুড়িসুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে–আলো জ্বালাতেও ঘুম ভাঙল না। কুমুর এই আরামে ঘুমোনোর উপর ওর রাগ ধরল। অধৈর্যের সঙ্গে মশারি খুলে ধপ্‌ করে বিছানার উপর বসে পড়ল। খাটটা শব্দ করে কেঁপে উঠল।

কুমু চমকে উঠে বসল। আজ মধুসূদন আসবে না বলেই জানত। হঠাৎ তাকে দেখে মুখে এমন একটা ভাব এল যে, তাই দেখে মধুসূদনের বুকের ভিতর দিয়ে যেন একটা শেল বিঁধল। মাথায় রক্ত চড়ে গেল, বলে উঠল, “আমাকে কোনোমতেই সইতে পারছ না, না?”

এমনতরো প্রশ্নের কী উত্তর দেবে কুমু তা ভেবেই পেলে না। সত্যিই হঠাৎ মধুসূদনকে দেখে ওর বুক কেঁপে উঠেছিল আতঙ্কে। তখন ওর মনটা সতর্ক ছিল না। যে ভাবটাকে ও নিজের কাছেও সর্বদা চেপে রাখতে চায়, যার প্রবলতা নিজেও কুমু সম্পূর্ণ জানে না সে তখন হঠাৎ আত্মপ্রকাশ করেছিল।

মধুসূদন চিবিয়ে চিবিয়ে বললে, “দাদার কাছে যাবার জন্যে তোমার দরবার?”

কুমু এই মুহূর্তেই ওর পায়ে পড়তে প্রস্তুত হয়েছিল, কিন্তু ওর মুখে দাদার নাম শুনেই শক্ত হয়ে উঠল। বললে, “না।”

“তুমি যেতে চাও না?”

“না, আমি চাই নে।”

“নবীনকে আমার কাছে দরবার করতে পাঠাও নি?”

“না, পাঠাই নি।”

“দাদার কাছে যাবার ইচ্ছে তাকে তুমি জানাও নি?”

“আমি তাঁকে বলেছিলুম, দাদাকে দেখতে আমি যাব না।”

“কেন?”

“তা আমি বলতে পারি নে।”

“বলতে পার না? আবার তোমার সেই নুরনগরি চাল?”

“আমি যে নুরনগরেরই মেয়ে।”

“যাও, তাদের কাছেই যাও। যোগ্য নও তুমি এখানকার। অনুগ্রহ করেছিলেম, মর্যাদা বুঝলে না। এখন অনুতাপ করতে হবে।”

কুমু কাঠ হয়ে বসে রইল, কোনো উত্তর করলে না। কুমুর হাত ধরে অসহ্য একটা ঝাঁকানি দিয়ে মধুসূদন বললে, “মাপ চাইতেও জান না?”

“কিসের জন্যে?”

“তুমি যে আমার এ বিছানার উপরে শুতে পেরেছ তার জন্যে।”

কুমু তংক্ষণাৎ বিছানা থেকে উঠে পাশের ঘরে চলে গেল।

মধুসূদন বাইরের ঘরে যাবার পথে দেখলে শ্যামাসুন্দরী সেই বারান্দায় উপুড় হয়ে পড়ে। মধুসূদন পাশে এসে নিচু হয়ে তার হাত ধরে টেনে তোলবার চেষ্টা করে বললে, “কী করছ, শ্যামা?” অমনি শ্যামা উঠে বসে মধুসূদনের দুই পা বুকে জড়িয়ে ধরলে, গদ্‌গদ কণ্ঠে বললে, “আমাকে মেরে ফেলো তুমি।”

মধুসূদন তাকে হাত ধরে তুলে দাঁড় করালে, বললে, “ইস্‌, তোমার গা যে একেবারে ঠাণ্ডা হিম। চলো তোমাকে শুইয়ে দিয়ে আসি গে।” বলে তাকে নিজের শালের এক অংশে আবৃত করে ডান হাত দিয়ে সবলে চেপে ধরে শোবার ঘরে পৌঁছিয়ে দিয়ে এল। শ্যামা চুপি চুপি বললে, “একটু বসবে না?”

মধুসূদন বললে, “কাজ আছে।”

রাতের বেলা কোথা থেকে ভূত চেপে এতক্ষণ মধুসূদনের কাজ নষ্ট করে দেবার জোগাড় করেছে– আর নয়। কুমুর কাছ থেকে যে উপেক্ষা পেয়েছে তার ক্ষতিপূরণের ভাণ্ডার অন্য কোথাও জমা আছে এটুকু সে বুঝে নিলে। ভালোবাসার ভিতর দিয়ে মানুষ আপনার যে পরম মূল্য উপলব্ধি করে, আজ রাত্রে সেই অনুভব করবার প্রয়োজন মধুসূদনের ছিল। শ্যামাসুন্দরী সমস্ত জীবনমন দিয়ে ওর জন্যে অপেক্ষা করে আছে, সেই আশ্বাসটুকু পেয়ে মধুসূদন আজ রাত্রে কাজের জোর পেলে, যে অমর্যাদার কাঁটা ওর মনের মধ্যে বিঁধে আছে তার বেদনা অনেকটা কমিয়ে দিলে।

0 Shares