যোগাযোগ

কুমু বিপ্রদাসের পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললে, “আমার জন্যে তুমি কিন্তু কিছু ভেবো না দাদা। আমাকে যিনি রক্ষা করবেন তিনি ভিতরেই আছেন, আমার বিপদ নেই।”

“আচ্ছা, থাক্‌ ও-সব কথা। তোকে যেমন গান শেখাতুম, ইচ্ছে করছে তেমনি করে আজ তোকে শেখাই।”

“ভাগ্যি শিখিয়েছিলে দাদা, ওতেই আমাকে বাঁচায়। কিন্তু আজ নয়, তুমি আগে একটু জোর পাও। আজ আমি বরঞ্চ তোমাকে একটা গান শোনাই।”

দাদার শিয়রের কাছে বসে কুমু আস্তে আস্তে গাইতে লাগল–

পিয়া ঘর আয়ে, সোহী পীতম পিয় প্যার রে।

মীরাকে প্রভু গিরিধর নাগর,

চরণকমল বলিহার রে।

বিপ্রদাস চোখ বুজে শুনতে লাগল। গাইতে গাইতে কুমুর দুই চক্ষু ভরে উঠল এক অপরূপ দর্শনে। ভিতরের আকাশ আলো হয়ে উঠল। প্রিয়তম ঘরে এসেছেন, চরণকমল বুকের মধ্যে ছুঁতে পাচ্ছে। অত্যন্ত সত্য হয়ে উঠল অন্তরলোক, যেখানে মিলন ঘটে। গান গাইতে গাইতে ও সেইখানে পৌঁচেছে। “চরণকমল বলিহার রে”–সমস্ত জীবন ভরে দিলে সেই চরণকমল, অন্ত নেই তার–সংসারে দুঃখ-অপমানের জায়গা রইল কোথায়। “পিয়া ঘর আয়ে” তার বেশি আর কী চাই। এই গান কোনোদিন যদি শেষ না হয় তা হলে তো চিরকালের মতো রক্ষা পেয়ে গেল কুমু।

কিছু রুটি-টোস্ট আর এক পেয়ালা বার্লি গোকুল টিপাই-এর উপর রেখে দিয়ে গেল। কুমু গান থামিয়ে বললে, “দাদা, কিছুদিন আগে মনে মনে গুরু খুঁজছিলুম, আমার দরকার কী? তুমি যে আমাকে গানের মন্ত্র দিয়েছ।”

“কুমু, আমাকে লজ্জা দিস নে। আমার মতো গুরু রাস্তায় ঘাটে মেলে, তারা অন্যকে যে মন্ত্র দেয় নিজে তার মানেই জানে না। কুমু, কতদিন এখানে থাকতে পারবি ঠিক করে বল্‌ দেখি?”

“যতদিন না ডাক পড়ে।”

“তুই এখানে আসতে চেয়েছিলি?”

“না, আমি চাই নি।”

“এর মানে কী?”

“মানের কথা ভেবে লাভ নেই দাদা। চেষ্টা করলেও বুঝতে পারব না। তোমার কাছে আসতে পেরেছি এই যথেষ্ট। যতদিন থাকতে পারি সেই ভালো। দাদা, তোমার খাওয়া হচ্ছে না, খেয়ে নাও।”

চাকর এসে খবর দিলে মুখুজ্যেমশায় এসেছেন। বিপ্রদাস একটু যেন ব্যস্ত হয়ে উঠে বললে, “ডেকে দাও।”

৪৭

কালু ঘরে ঢুকতেই কুমু তাকে প্রণাম করলে।

কালু বললে, “ছোটোখুকি, এসেছ? এইবার দাদার সেরে উঠতে দেরি হবে না।”

কুমুর চোখ ছল্‌ছল্‌ করে উঠল। অশ্রু সামলে নিয়ে বললে, “দাদা, তোমার বার্লিতে নেবুর রস দেবে না?”

বিপ্রদাস উদাসীন ভাবে হাত ওলটালে, অর্থাৎ না হলেই বা ক্ষতি কী? কুমু জানে বিপ্রদাস বার্লি খেতে ভালোবাসে না, তাই ও যখনই দাদাকে বার্লি খাইয়েছে বার্লিতে নেবুর রস এবং অল্প একটু গোলাপজল মিশিয়ে বরফ দিয়ে শরবতের মতো বানিয়ে দিত। সে আয়োজন আজ নেই, তবু বিপ্রদাস আপন ইচ্ছে কাউকে জানায়ও নি, যা পেয়েছে তাই বিতৃষ্ণার সঙ্গে খেয়েছে।

বার্লি ঠিকমত তৈরি করে আনবার জন্যে কুমু চলে গেল।

বিপ্রদাস উদ্‌বিগ্নমুখে জিজ্ঞাসা করলে, “কালুদা, খবর কী বলো।”

“তোমার একলার সইয়ে টাকা ধার দিতে কেউ রাজি হয় না, সুবোধের সই চায়। মাড়োয়ারি ধনীদের কেউ কেউ দিতে পারে, কিন্তু সেটা নিতান্ত বাজিখেলার মতো করে– অত্যন্ত বেশি সুদে চায়, সে আমাদের পোষাবে না।”

“কালুদা, সুবোধকে তার করতে হবে আসবার জন্যে। আর দেরি করলে তো চলবে না।”

“আমারও ভালো ঠেকছে না। সেবারে তোমার সেই আংটি-বেচা টাকা নিয়ে যখন মূল দেনার এক অংশ শোধ করতে গেলুম, মধুসূদন নিতে রাজিই হল না; তখনই বুঝলুম সুবিধে নয়। নিজের মর্জিমত একদিন হঠাৎ কখন ফাঁস এঁটে ধরবে।”

বিপ্রদাস চুপ করে ভাবতে লাগল।

কালু বললে, “দাদা, ছোটোখুকি যে হঠাৎ আজ সকালে চলে এল, রাগারাগি করে আসে নি তো? মধুসূদনকে চটাবার মতো অবস্থা আমাদের নয়, এটা মনে রাখতে হবে।”

“কুমু বলছে ওর স্বামীর সম্মতি পেয়েছে।”

“সম্মতিটার চেহারা কী রকম না জানলে মন নিশ্চিন্ত হচ্ছে না। কত সাবধানে ওর সঙ্গে ব্যবহার করি সে আর তোমাকে কী বলব দাদা। রাগে সর্ব অঙ্গ যখন জ্বলছে তখনো ঠাণ্ডা হয়ে সব সয়েছি, গৌরীশংকরের পাহাড়টার মতো দুপুররোদ্‌দুরেও তার বরফ গলে না। একে মহাজন তাতে ভগ্নীপতি, একে সামলে চলা কি সোজা কথা!”

বিপ্রদাস কোনো জবাব না করে চুপ করে ভাবতে লাগল।

কুমু এল বার্লি নিয়ে। বিপ্রদাসের মুখের কাছে পেয়ালা ধরে বললে, “দাদা, খেয়ে নাও।”

বিপ্রদাস তার ভাবনা থেকে হঠাৎ চমকে উঠল। কুমু বুঝতে পারলে, গভীর একটা উদ্‌বেগের মধ্যে দাদা এতক্ষণ ডুবে ছিল।

কালু যখন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল কুমু তার পিছন পিছন গিয়ে বারান্দায় ওকে ধরে বললে, “কালুদা, আমাকে সব কথা বলতে হবে।”

“কী কথা বলতে হবে দিদি?”

“তোমাদের কী একটা নিয়ে ভাবনা চলছে।”

“বিষয় আছে ভাবনা নেই, সংসারে এও কি কখনো সম্ভব হয় খুকি? ও যে কাঁটাগাছের ফল, খিদের চোটে পেড়ে খেতেও হয়, পাড়তে গিয়ে সর্বাঙ্গ ছড়েও যায়।”

“সে-সব কথা পরে হবে, আমাকে বলো কী হয়েছে।”

“বিষয়কর্মের কথা মেয়েদের বলতে নিষেধ।”

“আমি নিশ্চয় জানি তোমাদের কী নিয়ে কথা হচ্ছে। বলব?”

“আচ্ছা, বলো।”

“আমার স্বামীর কাছে দাদার ধার আছে, সেই নিয়ে।”

কোনো জবাব না দিয়ে কালু তার বড়ো বড়ো দুই চোখ সকৌতুক বিস্ময়হাস্যে বিস্ফারিত করে কুমুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

“আমাকে বলতেই হবে, ঠিক বলেছি কি না।”

0 Shares