যোগাযোগ

নিজের এইরকম দুর্বল অধিকারের মধ্যে শ্যামাসুন্দরীর মনে একটা আশঙ্কা লেগেই ছিল কবে আবার কুমু আপন সিংহাসনে ফিরে আসে। এই ঈর্ষার পীড়নে তার মনে একটুও শান্তি নেই। জানে কুমুর সঙ্গে ওর প্রতিযোগিতা চলবেই না, ওরা এক ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে নেই। কুমু মধুসূদনের আয়ত্তের অতীত, সেইখানেই তার অসীম জোর; আর শ্যামা তার এত বেশি আয়ত্তের মধ্যে যে, তার ব্যবহার আছে মূল্য নেই। এই নিয়ে শ্যামা অনেক কান্নাই কেঁদেছে, কতবার মনে করেছে আমার মরণ হলেই বাঁচি। কপাল চাপড়ে বলেছে এত বেশি সস্তা হলুম কেন? তার পরে ভেবেছে সস্তা বলেই জায়গা পেলুম, যার দর বেশি তার আদর বেশি, যে সস্তা সে হয়তো সস্তা বলেই জেতে।

মধুসূদন যখন শ্যামাকে গ্রহণ করে নি তখন শ্যামার এত অসহ্য দুঃখ ছিল না। সে আপন উপবাসী ভাগ্যকে একরকম করে মেনে নিয়েছিল। মাঝে মাঝে সামান্য খোরাককেই যথেষ্ট মনে হত। আজ অধিকার পাওয়া আর না-পাওয়ার মধ্যে সামঞ্জস্য কিছুতেই ঘটছে না। হারাই হারাই ভয়ে মন আতঙ্কিত। ভাগ্যের রেল-লাইন এমন কাঁচা করে পাতা যে, ডিরেলের ভয় সর্বত্রই এবং প্রতি মুহূর্তেই! মোতির মার কাছে মন খোলাখুলি করে সাত্ত্বনা পাবার জন্যে একবার চেষ্টা করেছিল। সে এমনি একটা ঝাঁঝের সঙ্গে মাথা-ঝাঁকানি দিয়ে পাশ কাটিয়ে গেছে যে, তার একটা কোনো সাংঘাতিক শোধ তুলতে পারলে এখনই তুলত, কিন্তু জানে সংসার-ব্যবস্থায় মধুসূদনের কাছে মোতির মার দাম আছে, সেখানে একটুও নাড়া সইবে না। সেই অবধি দুজনের কথা বন্ধ, পারতপক্ষে মুখ দেখাদেখি নেই। এমনি করে এ বাড়িতে শ্যামার স্থান পূর্বের চেয়ে আরো সংকীর্ণ হয়ে গেছে। কোথাও তার একটুও স্বচ্ছন্দতা নেই।

এমন সময় একদিন সন্ধেবেলায় শোবার ঘরে এসে দেখে টেবিলের উপর দেয়ালে হেলানো কুমুর ফোটোগ্রাফ। যে বজ্র মাথায় পড়বে তারই বিদ্যুৎশিখা ওর চোখে এসে পড়ল। যে মাছকে বঁড়শি বিঁধেছে তারই মতো করে ওর বুকের ভিতরটা ধড়্‌ফড়্‌ ধড়্‌ফড়্‌ করতে লাগল। ইচ্ছা করে ছবিটা থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়, পারে না। একদৃষ্টে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকল, মুখ বিবর্ণ, দুই চোখে একটা দাহ, মুঠো দৃঢ় করে বন্ধ। একটা কিছু ভাঙতে, একটা কিছু ছিঁড়ে ফেলতে চায়। এ ঘরে থাকলে এখনই কিছু একটা লোকসান করে ফেলবে এই ভয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। আপনার ঘরে গিয়ে বিছানার উপর উপুড় হয়ে পড়ে চাদরখানা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললে।

রাত হয়ে এল। বাইরে থেকে বেহারা খবর দিলে মহারাজ শোবার ঘরে ডেকে পাঠিয়েছেন। বলবার শক্তি নেই যে যাব না। তাড়াতাড়ি উঠে মুখ ধুয়ে একটা বুটিদার ঢাকাই শাড়ি পরে গায়ে একটু গন্ধ মেখে গেল শোবার ঘরে। ছবিটা যাতে চোখে না পড়ে এই তার চেষ্টা। কিন্তু ঠিক সেই ছবিটার সামনেই বাতি– সমস্ত আলো যেন কারো দীপ্ত দৃষ্টির মতো ঐ ছবিকে উদ্‌ভাসিত করে আছে। সমস্ত ঘরের মধ্যে ঐ ছবিটিই সব চেয়ে দৃশ্যমান। শ্যামা নিয়মমত পানের বাটা নিয়ে মধুসূদনকে পান দিলে, তার পরে পায়ের কাছে বসে পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। যে-কোনো কারণেই হোক আজ মধুসূদন প্রসন্ন ছিল। বিলাতি দোকানের থেকে একটা রুপোর ফোটোগ্রাফের ফ্রেম কিনে এনেছিল। গম্ভীরভাবে শ্যামাকে বললে, “এই নাও।” শ্যামাকে সমাদর করবার উপলক্ষেও মধুসূদন মধুর রসের অবতারণায় যথেষ্ট কার্পণ্য করে। কেননা সে জানে ওকে অল্প একটু প্রশ্রয় দিলেই ও আর মর্যাদা রাখতে পারে না। ব্রাউন কাগজে জিনিসটা মোড়া ছিল। আস্তে আস্তে কাগজের মোড়কটা খুলে ফেলে বললে, “কী হবে এটা?”

মধুসূদন বললে, “জান না, এতে ফোটোগ্রাফ রাখতে হয়।”

শ্যামার বুকের ভিতরটাতে কে যেন চাবুক চালিয়ে দিলে, বললে, “কার ফোটোগ্রাফ রাখবে?”

“তোমার নিজের। সেদিন সেই যে ছবিটা তোলানো হয়েছে।”

“আমার এত সোহাগে কাজ নেই।” বলে সেই ফ্রেমটা ছুঁড়ে মেজের উপর ফেলে দিলে।

মধুসূদন আশ্চর্য হয়ে বললে, “এর মানে কী হল?”

“এর মানে কিছুই নেই।” বলে মুখে হাত দিয়ে কেঁদে উঠল, তার পরে বিছানা থেকে মেজের উপর পড়ে মাথা ঠুকতে লাগল। মধুসূদন ভাবল, শ্যামার কম দামের জিনিস পছন্দ হয় নি, ওর বোধ করি ইচ্ছে ছিল একটা দামী গয়না পায়। সমস্ত দিন আপিসের কাজ সেরে এসে এই উপদ্রবটা একটুও ভালো লাগল না। এ-যে প্রায় হিস্‌টিরিয়া। হিস্‌টিরিয়ার ‘পরে ওর বিষম অবজ্ঞা। খুব একটা ধমক দিয়ে বললে, “ওঠো বলছি, এখনই ওঠো!”

শ্যামা উঠে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেল। মধুসূদন বললে, “এ কিছুতেই চলবে না।”

মধুসূদন শ্যামাকে বিশেষ ভাবেই জানে। নিশ্চয় ঠাওরেছিল একটু পরেই ফিরে এসে পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ে মাপ চাইবে– সেই সময়ে খুব শক্ত করে দুটো কথা শুনিয়ে দিতে হবে।

দশটা বাজল শ্যামা এল না। আর-একবার শ্যামার ঘরের দরজার বাইরে থেকে আওয়াজ এল, “মহারাজ বোলায়া।”

শ্যামা বললে, “মহারাজকে বলো আমার অসুখ করেছে।”

মধুসূদন ভাবলে, আস্পর্ধা তো কম নয়, হুকুম করলে আসে না।

মনে ঠিক করে রেখেছিল আরো খানিক বাদে আসবে। তাও এল না। এগারোটা বাজতে মিনিট পনেরো বাকি। বিছানা ছেড়ে মধুসূদন দ্রুত পদে শ্যামার ঘরে গিয়ে ঢুকল। দেখলে ঘরে আলো নেই। অন্ধকারে বেশ দেখা গেল– শ্যামা মেজের উপর পড়ে আছে। মধুসূদন ভাবলে এ-সমস্ত কেবল আদর-কাড়বার জেন্যে।

গর্জন করে বললে, “উঠে এসো বলছি, শীঘ্র উঠে এসো। ন্যাকামি কোরো না।”

শ্যামা কিছু না বলে উঠে এল।

0 Shares