যোগাযোগ

দাদার বুকের কাছে খাটের প্রান্তে মাথা রেখে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে কুমু বললে, “কিন্তু আমি তোমাদের তো ভার হয়ে থাকব না? ঠিক বলছ?”

কুমুর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বিপ্রদাস বললে, “ভার কেন হবি বোন? তোকে খুব খাটিয়ে নেব। আমার কাজ সব দেব তোর হাতে। কোনো প্রাইভেট সেক্রেটারি এমন করে কাজ করতে পারবে না। আমাকে তোর বাজনা শোনাতে হবে, আমার ঘোড়া তোর জিম্মেয় থাকবে। তা ছাড়া জানিস আমি শেখাতে ভালোবাসি। তোর মতো ছাত্রী পাব কোথায় বল্‌? এক কাজ করা যাবে, অনেক দিন থেকে পারসি পড়বার শখ আমার আছে। একলা পড়তে ভালো লাগে না। তোকে নিয়ে পড়ব, তুই নিশ্চয় আমার চেয়ে এগিয়ে যাবি, আমি একটুও হিংসে করব না দেখিস।”

শুনতে শুনতে কুমুর মন পুলকিত হয়ে উঠল, এর চেয়ে জীবনে সুখ আর কিছু হতে পারে না।

খানিক পরে বিপ্রদাস আবার বললে, “আরো-একটা কথা তোকে বলে রাখি কুমু, খুব শীঘ্রই আমাদের কাল বদল হবে, আমাদের চালও বদলাবে। আমাদের থাকতে হবে গরিবের মতো। তখন তুই থাকবি আমাদের গরিবের ঐশ্বর্য হয়ে।”

কুমুর চোখে জল এল, বললে, “আমার এমন ভাগ্য যদি হয় তো বেঁচে যাই।”

বিপ্রদাস মধুসূদনের চিঠি হাতে রাখলে, উত্তর দিলে না।

৫৬

দুদিন পরেই নবীন মোতির মা হাবলুকে নিয়ে এসে উপস্থিত। হাবলু জ্যাঠাইমার কোলে চড়ে তার বুকে মাথা রেখে কেঁদে নিলে। কান্নাটা কিসের জন্যে স্পষ্ট করে বলা শক্ত– অতীতের জন্যে অভিমান, না বর্তমানের জন্যে আবদার, না ভবিষ্যতের জন্যে ভাবনা?

কুমু হাবলুকে জড়িয়ে ধরে বললে, “কঠিন সংসার গোপাল, কান্নার অন্ত নেই। কী আছে আমার, কী দিতে পারি যাতে মানুষের ছেলের কান্না কমে! কান্না দিয়ে কান্না মেটাতে চাই, তার বেশি শক্তি নেই। যে ভালোবাসা আপনাকে দেয় তার অধিক আর কিছু দিতে পারে না, বাছারা, সেই ভালোবাসা তোরা পেয়েছিস; জ্যাঠাইমা চিরদিন থাকবে না, কিন্তু এই কথাটা মনে রাখিস, মনে রাখিস, মনে রাখিস।” বলে তার গালে চুমো খেলে।

নবীন বললে, “বউরানী, এবার রজবপুরে পৈতৃক ঘরে চলেছি; এখানকার পালা সাঙ্গ হল।”

কুমু ব্যাকুল হয়ে বললে, “আমি হতভাগিনী এসে তোমাদের এই বিপদ ঘটালুম।”

নবীন বললে, “ঠিক তার উলটো। অনেক দিন থেকেই মনটা যাই-যাই করছিল। বেঁধে-সেধে তৈরি হয়ে ছিলুম, এমন সময় তুমি এলে আমাদের ঘরে। ঘরের আশ খুব করেই মিটেছিল, কিন্তু বিধাতার সইল না।”

সেদিন মধুসূদন ফিরে গিয়ে তুমুল একটা বিপ্লব বাধিয়েছিল তা বোঝা গেল।

নবীন যাই বলুক, কুমুই যে ওদের সংসারের সমস্ত ওলটপালট করে দিয়েছে মোতির মার তাতে সন্দেহ নেই, আর সেই অপরাধ সে সহজে ক্ষমা করতে চায় না। তার মত এই যে, এখনো কুমুর সেখানে যাওয়া উচিত মাথা হেঁট করে, তার পরে যত লাঞ্ছনাই হোক সেটা মেনে নেওয়া চাই। গলা বেশ একটু কঠিন করেই জিজ্ঞাসা করলে, “তুমি কি শ্বশুরবাড়ি একেবারেই যাবে না ঠিক করেছ?”

কুমু তার উত্তরে শক্ত করেই বললে, “না, যাব না।”

মোতির মা জিজ্ঞাসা করলে, “তা হলে তোমার গতি কোথায়?”

কুমু বললে, “মস্ত এই পৃথিবী, এর মধ্যে কোনো-এক জায়গায় আমারও একটুখানি ঠাঁই হতে পারবে। জীবনে অনেক যায় খসে, তবুও কিছু বাকি থাকে।”

কুমু বুঝতে পারছিল, মোতির মার মন ওর কাছ থেকে অনেকখানি সরে এসেছে। নবীনকে জিজ্ঞাসা করলে, “ঠাকুরপো, তা হলে কী করবে এখন?”

“নদীর ধারে কিছু জমি আছে তার থেকে মোটা ভাতও জুটবে, কিছু হাওয়া খাওয়াও চলবে।”

মোতির মা উষ্মার সঙ্গেই বললে, “ওগো মশায়, না, সেজন্যে তোমাকে ভাবতে হবে না। ঐ মির্জাপুরের অন্নজলে দাবি রাখি, সে কেউ কাড়তে পারবে না। আমরা তো এত বেশি সম্মানী লোক নই, বড়োঠাকুর তাড়া দিলেই অমনি বিবাগী হয়ে চলে যাব। তিনিই আবার আজ বাদে কাল ফিরিয়ে ডাকবেন, তখন ফিরেও আসব, ইতিমধ্যে সবুর সইবে, এই বলে রাখলুম।”

নবীন একটু ক্ষুণ্ন হয়ে বললে, “সে কথা জানি মেজোবউ, কিন্তু তা নিয়ে বড়াই করি নে। পুনর্জন্ম যদি থাকে তবে সম্মানী হয়েই যেন জন্মাই, তাতে অন্নজলের যদি টানাটানি ঘটে সেও স্বীকার।”

বস্তত নবীন অনেকবারই দাদার আশ্রয় ছেড়ে গ্রামে চাষবাসের সংকল্প করেছে। মোতির মা মুখে তর্জনগর্জন করেছে, কাজের বেলায় কিছুতেই সহজে নড়তে চায় নি, নবীনকে বারে বারে আটকে রেখেছে। সে জানে ভাশুরের উপর তার সম্পূর্ণ দাবি আছে। ভাশুর তো শ্বশুরের স্থানীয়। তার মতে ভাশুর অন্যায় করতে পারে কিন্তু তাকে অপমান বলা চলে না। কুমুর প্রতি কুমুর স্বামীর ব্যবহার যেমনই হোক তাই বলে কুমু স্বামীর ঘর অস্বীকার করতে পারে, এ কথা মোতির মার কাছে নিতান্ত সৃষ্টিছাড়া।

খবর এল ডাক্তার এসেছে। কুমু বললে, “একটু অপেক্ষা করো, শুনে আসি ডাক্তার কী বলে।”

ডাক্তার কুমুকে বলে গেল, নাড়ি আরো খারাপ, রাত্তিরে ঘুম কমেছে, বোধ হয় রোগী ঠিক বিশ্রাম পাচ্ছে না।

অতিথিদের কাছে কুমু ফিরে যাচ্ছিল, এমন সময় কালু এসে বললে, “একটা কথা না বলে থাকতে পারছি নে, জাল বড়ো জটিল হয়ে এসেছে, তুমি যদি এই সময়ে শ্বশুরবাড়ি ফিরে না যাও, বিপদ আরো ঘনিয়ে ধরবে। আমি তো কোনো উপায় ভেবে পাচ্ছি নে।”

কুমু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কালু বললে, “তোমার স্বামীর ওখান থেকে তাগিদ এসেছে, সেটা অগ্রাহ্য করবার শক্তি কি আমাদের আছে? আমরা যে একেবারে তার মুঠোর মধ্যে।”

0 Shares