কুমু বোধ হয় একটু ইতস্তত করে একটু দেরি করেই এল। বিপ্রদাসের কাছে চৌকিতে বসেই বললে, “দাদা, আমার একটুও ভালো লাগছে না। আমার যেন কোথায় যেতে ইচ্ছে করছে।”
বিপ্রদাস বললে, “ভুল বলছিস কুমু, তোর ভালোই লাগবে। আর কিছুদিন পরেই তোর মন উঠবে ভরে।”
“কিন্তু তা হলে–” বলে কুমু থেমে গেল।
“তা জানি– এখন তোর বন্ধন কাটাবে কে?”
“তবে কি যেতে হবে দাদা?”
“তোকে নিষেধ করতে পারি এমন অধিকার আর আমার নেই। তোর সন্তানকে তার নিজের ঘরছাড়া করব কোন্ স্পর্ধায়?”
কুমু অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল, বিপ্রদাসও কিছু বললে না।
অবশেষে খুব মৃদুস্বরে কুমু জিজ্ঞাসা করলে, “তা হলে কবে যেতে হবে?”
“কালই, আর দেরি সইবে না।”
“দাদা, একটা কথা বোধ হয় বুঝতে পারছ, এবার গেলে ওরা আমাকে আর কখনো তোমার কাছে আসতে দেবে না।”
“তা আমি খুবই জানি।”
“আচ্ছা, তাই হবে। কিন্তু একটা কথা তোমাকে বলে রাখি, কোনোদিন কোনো কারণেই তুমি ওদের বাড়ি যেতে পারবে না। জানি দাদা, তোমাকে দেখবার জন্যে আমার প্রাণ হাঁপিয়ে উঠবে, কিন্তু ওদের ওখানে যেন কখনো তোমাকে না দেখতে হয়। সে আমি সইতে পারব না।”
“না কুমু, সেজন্যে তোমাকে ভাবতে হবে না।”
“ওরা কিন্তু তোমাকে বিপদে ফেলবার চেষ্টা করবে।”
“ওরা যা করতে পারে তা করা শেষ হলেই আমার উপর ওদের ক্ষমতাও শেষ হবে। তখনই আমি হব স্বাধীন। তাকে তুই বিপদ বলছিস কেন?”
“দাদা, সেইদিন তুমি আমাকেও স্বাধীন করে নিয়ো। ততদিন ওদের ছেলেকে আমি ওদের হাতে দিয়ে যাব। এমন কিছু আছে যা ছেলের জন্যেও খোওয়ানো যায় না।”
“আচ্ছা, আগে হোক ছেলে, তার পরে বলিস।”
“তুমি বিশ্বাস করছ না, কিন্তু মার কথা মনে আছে তো? তাঁর তো হয়েছিল ইচ্ছামৃত্যু। সেদিন সংসারে তিনি তাঁর জায়গাটি পাচ্ছিলেন না, তাই তাঁর ছেলেমেয়েদেরকে অনায়াসে ফেলে দিয়ে যেতে পেরেছিলেন। মানুষ যখন মুক্তি চায় তখন কিছুতেই তাকে ঠেকাতে পারে না। আমি তোমারই বোন, দাদা, আমি মুক্তি চাই। একদিন যেদিন বাঁধন কাটব, মা সেদিন আমাকে আশীর্বাদ করবেন এই আমি তোমাকে বলে রাখলুম।”
আবার অনেকক্ষণ দুজনে চুপ করে রইল। হঠাৎ হু হু করে বাতাস উঠল, টিপায়ের উপর বিপ্রদাসের পড়বার বইটার পাতাগুলো ফর্ ফর্ করে উলটে যেতে লাগল। বাগান থেকে বেলফুলের গন্ধে ঘর গেল ভরে।
কুমু বললে, “আমাকে ওরা ইচ্ছে করে দুঃখ দিয়েছে তা মনে করো না। আমাকে সুখ ওরা দিতে পারে না আমি এমনি করেই তৈরি। আমিও তো ওদের পারব না সুখী করতে। যারা সহজে ওদের সুখী করতে পারে তাদের জায়গা জুড়ে কেবল একটা-না-একটা মুশকিল বাধবে। তা হলে কেন এ বিড়ম্বনা? সমাজের কাছ থেকে অপরাধের সমস্ত লাঞ্ছনা আমিই একলা মেনে নেব, ওদের গায়ে কোনো কলঙ্ক লাগবে না। কিন্তু একদিন ওদের মুক্তি দেব, আমিও মুক্তি নেব; চলে আসবই এ তুমি দেখে নিয়ো। মিথ্যে হয়ে মিথ্যের মধ্যে থাকতে পারব না। আমি ওদের বড়োবউ, তার কি কোনো মানে আছে যদি আমি কুমু না হই? দাদা, তুমি ঠাকুর বিশ্বাস কর না, আমি বিশ্বাস করি। তিন মাস আগে যেরকম করে করতুম, আজ তার চেয়ে বেশি করেই করি। আজ সমস্ত দিন ধরেই এই কথা ভাবছি যে, চারি দিকে এত এলোমেলো, এত উলটো-পালটা, তবু এই জঞ্জালে একেবারে ঢেকে ফেলে নি জগৎটাকে। এ-সমস্তকে ছাড়িয়ে গিয়েও চন্দ্রসূর্যকে নিয়ে সংসারের কাজ চলছে, সেই যেখানে ছাড়িয়ে গেছে সেইখানে আছে বৈকুণ্ঠ, সেইখানে আছেন আমার ঠাকুর। তোমার কাছে এ-সব কথা বলতে লজ্জা করে–কিন্তু আর তো কখনো বলা হবে না, আজ বলে যাই। নইলে আমার জন্যে মিছিমিছি ভাববে। সমস্ত গিয়েও তবু বাকি থাকে এই কথাটা বুঝতে পেরেছি। সেই আমার অফুরান, সেই আমার ঠাকুর, এ যদি না বুঝতুম তা হলে এইখানে তোমার পায়ে মাথা ঠুকে মরতুম, সে গারদে ঢুকতুম না। দাদা, এ সংসারে তুমি আমার আছ বলেই তবে এ কথা বুঝতে পেরেছি।” এই বলেই কুমু চৌকি থেকে নেবে দাদার পায়ের উপর মাথা রেখে পড়ে রইল। রাত বেড়ে চলল, বিপ্রদাস জানালার বাইরে অনিমেষ দৃষ্টি মেলে ভাবতে লাগল।
৫৮
পরদিন ভোরে বিপ্রদাস কুমুকে ডেকে পাঠালে। কুমু এসে দেখে বিপ্রদাস বিছানায় বসে, একটি এসরাজ আছে কোলের উপর, আর একটি পাশে শোওয়ানো। কুমুকে বললে, “নে যন্ত্রটা, আমরা দুজনে মিলে বাজাই।” তখনো অল্প অল্প অন্ধকার, সমস্ত রাত্রির পরে বাতাস একটু ঠাণ্ডা হয়ে অশথপাতার মধ্যে ঝির্ ঝির্ করছে, কাকগুলো ডাকতে শুরু করেছে। দুজনে ভৈরোঁ রাগিণীতে আলাপ শুরু করলে, গম্ভীর শান্ত সকরুণ; সতীবিরহ যখন অচঞ্চল হয়ে এসেছে, মহাদেবের সেইদিনকার প্রভাতের ধ্যানের মতো। বাজাতে বাজাতে পুষ্পিত কৃষ্ণচূড়ার ডালের ভিতর দিয়ে অরুণ-আভা উজ্জ্বলতর হয়ে উঠল, সূর্য দেখা দিল বাগানের পাঁচিলের উপরে। চাকররা দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে গেল। ঘর সাফ করা হল না। রোদ্দুর ঘরের মধ্যে এল, দারোয়ান আস্তে আস্তে এসে খবরের কাগজ টিপাইয়ের উপর রেখে দিয়ে নিঃশব্দপদে চলে গেল।
অবশেষে বাজনা বন্ধ করে বিপ্রদাস বললে, “কুমু, তুই মনে করিস আমার কোনো ধর্ম নেই। আমার ধর্মকে কথায় বলতে গেলে ফুরিয়ে যায় তাই বলি নে। গানের সুরে তার রূপ দেখি, তার মধ্যে গভীর দুঃখ গভীর আনন্দ এক হয়ে মিলে গেছে; তাকে নাম দিতে পারি নে। তুই আজ চলে যাচ্ছিস কুমু, আর হয়তো দেখা হবে না, আজ সকালে তোকে সেই সকল বেসুরের সকল অমিলের পরপারে এগিয়ে দিতে এলুম। শকুন্তলা পড়েছিস– দুষ্যন্তের ঘরে যখন শকুন্তলা যাত্রা করে বেরিয়েছিল, কন্ব কিছুদূর পর্যন্ত তাকে পৌঁছিয়ে দিলেন। যে লোকে তাকে উত্তীর্ণ করতে তিনি বেরিয়েছিলেন, তার মাঝখানে ছিল দুঃখ-অপমান। কিন্তু সেইখানেই থামল না, তাও পেরিয়ে শকুন্তলা পৌঁচেছিল অচঞ্চল শান্তিতে। আজ সকালের ভৈরোঁর মধ্যে সেই শান্তির সুর, আমার সমস্ত অন্তঃকরণের আশীর্বাদ তোকে সেই নির্মল পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে দিক; সেই পরিপূর্ণতা তোর অন্তরে তোর বাহিরে, তোর সব দুঃখ তোর সব অপমান প্লাবিত করুক।”