রাজর্ষি

কথাটা গোবিন্দমাণিক্যের মনে লাগিল। তিনি নিরুত্তর হইয়া কিছুক্ষণ বসিয়া রহিলেন। অবশেষে নিতান্ত কাতর হইয়া বলিলেন, “মনে করো-না ঠাকুর, আমার পরাজয় হইয়াছে, নক্ষত্র আমাকে বধ করিয়া রাজা হইয়াছে।”

বিল্বন কহিলেন, “যদি সত্য তাহাই ঘটে তাহা হইলে আমি মহারাজের জন্য শোক করিব না। কিন্তু মহারাজ যদি কর্তব্যে ভঙ্গ দিয়া পলায়ন করেন, তবেই আমাদের শোকের কারণ ঘটিবে।”

রাজা কিঞ্চিৎ অধীর হইয়া কহিলেন, “আপন ভাইয়ের রক্তপাত করিব!”

বিল্বন কহিলেন, “কর্তব্যের কাছে ভাই বন্ধু কেহই নাই। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কী উপদেশ দিয়াছিলেন স্মরণ করিয়া দেখুন।”

রাজা কহিলেন, “ঠাকুর, তুমি কি বল আমি স্বহস্তে এই তরবারি লইয়া নক্ষত্ররায়কে আঘাত করিব?”

বিল্বন কহিলেন, “হাঁ।”

সহসা ধ্রুব আসিয়া গম্ভীর ভাবে কহিল, “ছি, ও কথা বলতে নেই।”

ধ্রুব খেলা করিতেছিল, দুই পক্ষের কী একটা গোলমাল শুনিয়া সহসা তাহার মনে হইল দুইজনে অবশ্যই একটা দুষ্টামি করিতেছে, অতএব সময় থাকিতে দুইজনকে কিঞ্চিৎ শাসন করিয়া আসা আবশ্যক। এই-সকল বিবেচনা করিয়া তিনি হঠাৎ আসিয়া ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, “ছি, ও কথা বলতে নেই।”

পুরোহিত ঠাকুরের অত্যন্ত আমোদ বোধ হইল। তিনি হাসিয়া উঠিলেন, ধ্রুবকে কোলে লইয়া চুমো খাইতে লাগিলেন। কিন্তু রাজা হাসিলেন না। তাঁহার মনে হইল যেন বালকের মুখে তিনি দৈববাণী শুনিলেন।

তিনি অসন্দিগ্ধ স্বরে বলিয়া উঠিলেন, “ঠাকুর, আমি স্থির করিয়াছি এ রক্তপাত আমি ঘটিতে দিব না, আমি যুদ্ধ করিব না।”

বিল্বন ঠাকুর কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। অবশেষে কহিলেন, “মহারাজের যদি যুদ্ধ করিতেই আপত্তি থাকে, তবে আর-এক কাজ করুন। আপনি নক্ষত্ররায়ের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাঁহাকে যুদ্ধ হইতে বিরত করুন।”

গোবিন্দমাণিক্য কহিলেন, “ইহাতে আমি সম্মত আছি।”

বিল্বন কহিলেন, “তবে সেইরূপ প্রস্তাব লিখিয়া নক্ষত্ররায়ের নিকট পাঠানো হউক।”

অবশেষে তাহাই স্থির হইল।

চতুস্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

নক্ষত্ররায় সৈন্য লইয়া অগ্রসর হইতে লাগিলেন, কোথাও তিলমাত্র বাধা পাইলেন না। ত্রিপুরার যে গ্রামেই তিনি পদার্পণ করিলেন সেই গ্রামই তাঁহাকে রাজা বলিয়া বরণ করিতে লাগিল। পদে পদে রাজত্বের আস্বাদ পাইতে লাগিলেন– ক্ষুধা আরও বাড়িতে লাগিল, চারি দিকের বিস্তৃত ক্ষেত্র, গ্রাম, পর্বতশ্রেণী, নদী সমস্তই “আমার” বলিয়া মনে হইতে লাগিল এবং সেই অধিকারব্যাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে নিজেও যেন অনেক দূর পর্যন্ত ব্যাপ্ত হইয়া অত্যন্ত প্রশস্ত হইয়া পড়িতে লাগিলেন। মোগল-সৈন্যরা যাহা চায় তিনি তাহাই তাহাদিগকে লইতে আলী হুকুম দিয়া দিলেন। মনে হইল এ-সমস্তই আমার এবং ইহারা আমারই রাজ্যে আসিয়া পড়িয়াছে। ইহাদিগকে কোনো সুখ হইতে বঞ্চিত করা হইবে না– স্বস্থানে ফিরিয়া গিয়া মোগলেরা তাঁহার আতিথ্যের ও রাজবৎ উদারতা ও বদান্যতার অনেক প্রশংসা করিবে; বলিবে, “ত্রিপুরার রাজা বড়ো কম রাজা নহে।” মোগলসৈন্যদের নিকট হইতে খ্যাতি লাভ করিবার জন্য তিনি সততই উৎসুক হইয়া রহিলেন। তাহারা তাঁহাকে কোনো-প্রকার শ্রুতিমধুর সম্ভাষণ করিলে তিনি নিতান্ত জল হইয়া যান। সর্বদাই ভয় হয় পাছে কোনো নিন্দার কারণ ঘটে।

রঘুপতি আসিয়া কহিলেন, “মহারাজ, যুদ্ধের তো কোনো উদ্‌যোগ দেখা যাইতেছে না।”

নক্ষত্ররায় কহিলেন, “না ঠাকুর, ভয় পাইয়াছে।”

বলিয়া অত্যন্ত হাসিতে লাগিলেন।

রঘুপতি হাসিবার বিশেষ কোনো কারণ দেখিলেন না, কিন্তু তথাপি হাসিলেন।

নক্ষত্ররায় কহিলেন, “নক্ষত্ররায় নবাবের সৈন্য লইয়া আসিয়াছে। বড়ো সহজ ব্যাপার নহে।”

রঘুপতি কহিলেন, “দেখি এবার কে কাহাকে নির্বাসনে পাঠায়। কেমন?”

নক্ষত্ররায় কহিলেন, “আমি ইচ্ছা করিলে নির্বাসনদণ্ড দিতে পারি, কারারুদ্ধ করিতেও পারি– বধের হুকুম দিতেও পারি। এখনো স্থির করি নাই কোন্‌টা করিব।”

বলিয়া অতিশয় বিজ্ঞভাবে অনেক বিবেচনা করিতে লাগিলেন।

রঘুপতি কহিলেন, “অত ভাবিবেন না মহারাজ। এখনো অনেক সময় আছে। কিন্তু আমার ভয় হইতেছে, গোবিন্দমাণিক্য যুদ্ধ না করিয়াই আপনাকে পরাভূত করিবেন।”

নক্ষত্ররায় কহিলেন, “সে কেমন করিয়া হইবে?”

রঘুপতি কহিলেন, “গোবিন্দমাণিক্য সৈন্যগুলোকে আড়ালে রাখিয়া বিস্তর ভ্রাতৃস্নেহ দেখাইবেন। গলা ধরিয়া বলিবেন– ছোটো ভাই আমার, এস ঘরে এস, দুধ-সর খাওসে। মহারাজ কাঁদিয়া বলিবেন– যে আজ্ঞে, আমি এখনি যাইতেছি। অধিক বিলম্ব হইবে না। বলিয়া নাগরা জুতোজোড়াটা পায়ে দিয়া দাদার পিছনে পিছনে মাথা নিচু করিয়া টাট্টু ঘোড়াটির মতো চলিবেন। বাদশাহের মোগল ফৌজ তামাশা দেখিয়া হাসিয়া ঘরে ফিরিয়া যাইবে।”

নক্ষত্ররায় রঘুপতির মুখে এই তীব্র বিদ্রূপ শুনিয়া অত্যন্ত কাতর হইয়া পড়িলেন। কিঞ্চিৎ হাসিবার নিষ্ফল চেষ্টা করিয়া বলিলেন, “আমাকে কি ছেলেমানুষ পাইয়াছে যে এমনি করিয়া ভুলাইবে। তাহার জো নাই। সে হবে না ঠাকুর। দেখিয়া লইয়ো।”

সেইদিন গোবিন্দমাণিক্যের চিঠি আসিয়া পৌঁছিল। সে চিঠি রঘুপতি খুলিলেন। রাজা অত্যন্ত স্নেহপ্রকাশ করিয়া সাক্ষাৎ প্রার্থনা করিয়াছেন। চিঠি নক্ষত্ররায়কে দেখাইলেন না। দূতকে বলিয়া দিলেন, “কষ্ট স্বীকার করিয়া গোবিন্দমাণিক্যের এতদূর আসিবার দরকার নেই। সৈন্য ও তরবারি লইয়া মহারাজ নক্ষত্রমাণিক্য শীঘ্রই তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন। গোবিন্দমাণিক্য এই অল্প কাল যেন প্রিয়ভ্রাতৃবিরহে অধিক কাতর হইয়া না পড়েন। আট বৎসর নির্বাসনে থাকিলে ইহা অপেক্ষা আরও অধিক কাল বিচ্ছেদের সম্ভাবনা ছিল।”

0 Shares