রাজর্ষি

রাজা কহিলেন, “না নয়নরায়, আমার তরবারি-উষ্ণীষে প্রয়োজন নাই। ইহারা আমার কী করিবে? আমি এখন ইহা অপেক্ষা অনেক গুরুতর অপমান সহ্য করিতে পারি। মুক্ত তরবারি তুলিয়া আমি এ পৃথিবীর লোকের নিকট হইতে আর সম্মান আদায় করিতে চাহি না। পৃথিবীর সর্বসাধারণে যেরূপ সুসময়ে দুঃসময়ে মান-অপমান সুখদুঃখ সহ্য করিয়া থাকে, আমিও জগদীশ্বরের মুখ চাহিয়া সেইরূপ সহ্য করিব। বন্ধুরা বিপক্ষ হইতেছে, আশ্রিতেরা কৃতঘ্ন হইতেছে, প্রণতেরা দুর্বিনীত হইয়া উঠিতেছে, এক কালে হয়তো ইহা আমার অসহ্য হইত, কিন্তু এখন ইহা সহ্য করিয়াই আমি হৃদয়ের মধ্যে আনন্দ লাভ করিতেছি। যিনি আমার বন্ধু তাঁহাকে আমি জানিয়াছি। যাও নয়নরায়, তুমি ফিরিয়া যাও, নক্ষত্রকে সমাদরপূর্বক আহ্বান করিয়া আনো, আমাকে যেমন সম্মান করিতে নক্ষত্রকেও তেমনি সম্মান করিয়ো। তোমরা সকলে মিলিয়া সর্বদা নক্ষত্রকে সুপথে এবং প্রজার কল্যাণে রক্ষা করো, তোমাদের কাছে আমার বিদায়কালের এই প্রার্থনা। দেখিয়ো, ভ্রমেও কখনো যেন আমার কথার উল্লেখ করিয়া বা আমার সহিত তুলনা করিয়া তাহার তিলমাত্র নিন্দা করিয়ো না। তবে আমি বিদায় হই।”

বলিয়া রাজা তাঁহার সভাসদের সহিত কোলাকুলি করিয়া অগ্রসর হইলেন, সভাসদ তাঁহাকে প্রণাম করিয়া অশ্রুজল মুছিয়া চলিয়া গেলেন।

যখন গোমতীতীরের উচ্চ পাড়ের কাছে গিয়া পৌঁছিলেন তখন বিল্বন ঠাকুর অরণ্য হইতে বাহির হইয়া তাঁহার সম্মুখে আসিয়া অঞ্জলি তুলিয়া কহিলেন, “জয় হউক।”

রাজা অশ্ব হইতে নামিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিলেন।

বিল্বন কহিলেন, “আমি তোমার কাছে বিদায় লইতে আসিয়াছি।”

রাজা কহিলেন, “ঠাকুর, তুমি নক্ষত্রের কাছে থাকিয়া তাহাকে সৎপরামর্শ দাও। রাজ্যের হিতসাধন করো।”

বিল্বন কহিলেন, “না। তুমি যেখানে রাজা নও সেখানে আমি অকর্মণ্য। এখানে থাকিয়া আমি আর কোনো কাজ করিতে পারিব না।”

রাজা কহিলেন, “তবে কোথায় যাইবে, ঠাকুর? আমাকে তবে দয়া করো, তোমাকে পাইলে আমি দুর্বল হৃদয়ে বল পাই।”

বিল্বন কহিলেন, “কোথায় আমার কাজ আছে আমি তাহাই অনুসন্ধান করিতে চলিলাম। আমি কাছে থাকি আর দূরে থাকি তোমার প্রতি আমার প্রেম কখনো বিচ্ছিন্ন হইবে না জানিয়ো। কিন্তু তোমার সহিত বনে গিয়া আমি কী করিব?”

রাজা মৃদুস্বরে কহিলেন, “তবে আমি বিদায় হই।” বলিয়া দ্বিতীয়বার প্রণাম করিলেন। বিল্বন এক দিকে চলিয়া গেলেন, রাজা অন্য দিকে চলিয়া গেলেন।

অষ্টাত্রিংশ পরিচ্ছেদ

নক্ষত্ররায় ছত্রমাণিক্য নাম ধারণ করিয়া মহাসমারোহে রাজপদ গ্রহণ করিলেন। রাজকোষে অর্থ অধিক ছিল না। প্রজাদের যথাসর্বস্ব হরণ করিয়া প্রতিশ্রুত অর্থ দিয়া মোগল-সৈন্যদের বিদায় করিতে হইল। ঘোরতর দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র৻ লইয়া ছত্রমাণিক্য রাজত্ব করিতে লাগিলেন। চতুর্দিক হইতে অভিশাপ ও ক্রন্দন বর্ষিত হইতে লাগিল।

যে আসনে গোবিন্দমাণিক্য বসিতেন, যে শয্যায় গোবিন্দমাণিক্য শয়ন করিতেন, যে-সকল লোক গোবিন্দমাণিক্যের প্রিয় সহচর ছিল, তাহারা যেন রাত্রিদিন নীরবে ছত্রমাণিক্যকে ভর্ৎসনা করিতে লাগিল। ছত্রমাণিক্যের ক্রমে তাহা অসহ্য বোধ হইতে লাগিল। তিনি চোখের সম্মুখ হইতে গোবিন্দমাণিক্যের সমস্ত চিহ্ন মুছিতে আরম্ভ করিলেন। গোবিন্দমাণিক্যের ব্যবহার্য সামগ্রী নষ্ট করিয়া ফেলিলেন এবং তাঁহার প্রিয় অনুচরদিগকে দূর করিয়া দিলেন। গোবিন্দমাণিক্যের নামগন্ধ তিনি আর সহ্য করিতে পারিতেন না। গোবিন্দমাণিক্যের কোনো উল্লেখ হইলেই তাঁহার মনে হইত সকলে তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়াই এই উল্লেখ করিতেছে। সর্বদা মনে হইত সকলে তাঁহাকে রাজা বলিয়া যথেষ্ট সম্মান করিতেছে না; এইজন্য সহসা অকারণে ক্ষাপা হইয়া উঠিতেন, সভাসদ্‌দিগকে শশব্যস্ত থাকিতে হইত।

তিনি রাজকার্য কিছুই বুঝিতেন না; কিন্তু কেহ পরামর্শ দিতে আসিলে তিনি চটিয়া উঠিয়া বলিতেন, “আমি আর এইটে বুঝি নে! তুমি কি আমাকে নির্বোধ পাইয়াছ!”

তাঁহার মনে হইত, সকলে তাঁহাকে সিংহাসনে অনধিকারী রাজ্যাপহারক জ্ঞান করিয়া মনে মনে তাচ্ছিল্য করিতেছে। এইজন্য সজোরে অত্যধিক রাজা হইয়া উঠিলেন; যথেচ্ছাচরণ করিয়া সর্বত্র তাঁহার একাধিপত্য প্রচার করিতে লাগিলেন। তিনি যে রাখিলে রাখিতে পারেন, মারিলে মারিতে পারেন, ইহা বিশেষরূপে প্রমাণ করিবার জন্য যাহাকে রাখা উচিত নহে তাহাকে রাখিলেন– যাহাকে মারা উচিত নহে তাহাকে মারিলেন। প্রজারা অন্নাভাবে মরিতেছে, কিন্তু তাঁহার দিনরাত্রি সমারোহের শেষ নাই– অহরহ নৃত্য গীত বাদ্য ভোজ। ইতিপূর্বে আর-কোনো রাজা সিংহাসনে চড়িয়া বসিয়া রাজত্বের পেখম সমস্তটা ছড়াইয়া দিয়া এমন অপূর্ব নৃত্য করে নাই।

প্রজারা চারি দিকে অসন্তোষ প্রকাশ করিতে লাগিল– ছত্রমাণিক্য তাহাতে অত্যন্ত জ্বলিয়া উঠিলেন; তিনি মনে করিলেন, এ কেবল রাজার প্রতি অসম্মান-প্রদর্শন। তিনি অসন্তোষের দ্বিগুণ কারণ জন্মাইয়া দিয়া বলপূর্বক পীড়নপূর্বক ভয় দেখাইয়া সকলের মুখ বন্ধ করিয়া দিলেন; সমস্ত রাজ্য নিদ্রিত নিশীথের মতো নীরব হইয়া গেল। সেই শান্ত নক্ষত্ররায় ছত্রমাণিক্য হইয়া যে সহসা এরূপ আচরণ করিবেন ইহাতে আশ্চর্যের বিষয় কিছুই নাই। অনেক সময়ে দুর্বলহৃদয়েরা প্রভুত্ব পাইলে এইরূপ প্রচণ্ড ও যথেচ্ছাচারী হইয়া উঠে।

0 Shares