রাজর্ষি

এইরূপে গোবিন্দমাণিক্য এক শত ধ্রুবকে লইয়া দিনযাপন করিতে লাগিলেন।

ত্রিচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

এ দিকে শা সুজা তাঁহার ভ্রাতা ঔরংজীবের সৈন্য-কর্তৃক তাড়িত হইয়া পলায়ন করিতেছেন। এলাহাবাদের নিকট যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁহার পরাজয় হয়। বিপক্ষ পরাক্রান্ত, এবং এই বিপদের সময় সুজা স্বপক্ষীয়দেরও বিশ্বাস করিতে পারিলেন না। তিনি অপমানিত ও ভীত ভাবে ছদ্মবেশে সামান্য লোকের মতো একাকী পলায়ন করিতে লাগিলেন। যেখানেই যান পশ্চাতে শত্রুসৈন্যের ধূলিধ্বজা ও তাহাদের অশ্বের ক্ষুরধ্বনি তাঁহাকে অনুসরণ করিতে লাগিল। অবশেষে পাটনায় পৌঁছিয়া তিনি পুনর্বার নবাব-বেশে আপন পরিবার ও প্রজাদের নিকটে আগমন-সংবাদ ঘোষণা করিলেন। তিনিও যেমন পাটনায় পৌঁছিলেন, তাহার কিছু কাল পরেই ঔরংজীবের পুত্র কুমার মহম্মদ সৈন্য-সহিত পাটনার দ্বারে আসিয়া পৌঁছিলেন। সুজা পাটনা ছাড়িয়া মুঙ্গেরে পলাইলেন।

মুঙ্গেরে তাঁহার বিক্ষিপ্ত দলবল কতক কতক তাঁহার নিকটে আসিয়া জুটিল এবং সেখানে তিনি নূতন সৈন্যও সংগ্রহ করলেন। তেরিয়াগড়ি ও শিকলিগলির দুর্গ সংস্কার করিয়া এবং নদীতীরে পাহাড়ের উপরে প্রাচীর নির্মাণ করিয়া তিনি দৃঢ় হইয়া বসিলেন।

এ দিকে ঔরংজীব তাঁহার বিচক্ষণ সেনাপতি মীর্‌জুমলাকে কুমার মহম্মদের সাহায্যে পাঠাইলেন। কুমার মহম্মদ প্রকাশ্য ভাবে মুঙ্গেরের দুর্গের অনতিদূরে আসিয়া শিবির স্থাপন করিলেন, এবং মীর্‌জুমলা অন্য গোপন পথ দিয়া মুঙ্গের-অভিমুখে যাত্রা করিলেন। যখন সুজা কুমার মহম্মদের সহিত ছোটোখাটো যুদ্ধে ব্যাপৃত আছেন, এমন সময় সহসা সংবাদ পাইলেন যে, মীর্‌জুমলা বহুসংখ্যক সৈন্য লইয়া বসন্তপুরে আসিয়া পৌঁছিয়াছেন। সুজা ব্যস্ত হইয়া তৎক্ষণাৎ তাঁহার সমস্ত সৈন্য লইয়া মুঙ্গের ছাড়িয়া রাজমহলে পলায়ন করিলেন। সেখানেই তাঁহার সমস্ত পরিবার বাস করিতেছিল। সম্রাট-সৈন্য অবিলম্বে সেখানেও তাঁহার অনুসরণ করিল। সুজা ছয় দিন ধরিয়া প্রাণপণে যুদ্ধ করিয়া শত্রুসৈন্যকে অগ্রসর হইতে দিলেন না। কিন্তু যখন দেখিলেন আর রক্ষা হয় না, তখন একদিন অন্ধকার ঝড়ের রাত্রে তাঁহার পরিবারসকল যথাসম্ভব ধনসম্পত্তি লইয়া নদী পার হইয়া তোণ্ডায় পলায়ন করিলেন, এবং অবিলম্বে সেখানকার দুর্গ-সংস্কারে প্রবৃত্ত হইলেন।

এই সময় ঘনবর্ষা আসিল, নদী অত্যন্ত স্ফীত এবং পথ দুর্গম হইয়া উঠিল। সম্রাট-সৈন্যেরা অগ্রসর হইতে পারিল না।

এই যুদ্ধবিগ্রহের পূর্বে কুমার মহম্মদের সহিত সুজার কন্যার বিবাহের সমস্ত স্থির হইয়াছিল। কিন্তু এই যুদ্ধের উপদ্রবে সে প্রস্তাব উভয় পক্ষই বিস্মৃত হইয়াছিল।

বর্ষায় তখন যুদ্ধ স্থগিত আছে এবং মীর্‌জুমলা রাজমহল হইতে কিছু দূরে তাঁহার শিবির লইয়া গেছেন, এমন সময় সুজার একজন সৈনিক তোণ্ডার শিবির হইতে আসিয়া গোপনে কুমার মহম্মদের হস্তে একখানি পত্র দিল। কুমার খুলিয়া দেখিলেন সুজার কন্যা লিখিতেছেন, “কুমার, এই কি আমার অদৃষ্টে ছিল? যাঁহাকে মনে মনে স্বামীরূপে বরণ করিয়া আমার সমগ্র হৃদয় সমর্পণ করিয়াছি, যিনি অঙ্গুরীয়-বিনিময় করিয়া আমাকে গ্রহণ করিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুত হইয়াছিলেন– তিনি আজ নিষ্ঠুর তরবারি হস্তে আমার পিতার প্রাণ লইতে আসিয়াছেন, এই কি আমাকে দেখিতে হইল? কুমার, এই কি আমাদের বিবাহ-উৎসব? তাই কি এত সমারোহ? তাই কি আমাদের রাজমহল আজ রক্তবর্ণ? তাই কি, কুমার দিল্লি হইতে লোহার শৃঙ্খল হাতে করিয়া আনিয়াছেন? এই কি প্রেমের শৃঙ্খল?”

এই পত্র পড়িয়া সহসা প্রবল ভূমিকম্পে যেন কুমার মহম্মদের হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া গেল। তিনি এক মুহূর্ত আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। তৎক্ষণাৎ সাম্রাজ্যের আশা, বাদশাহের অনুগ্রহ, সমস্ত তিনি তুচ্ছ জ্ঞান করিলেন। প্রথম যৌবনের দীপ্ত হুতাশনে তিনি ক্ষতিলাভের বিবেচনা সমস্ত বিসর্জন করিলেন। তাঁহার পিতার সমস্ত কার্য তাঁহার অত্যন্ত অন্যায় ও নিষ্ঠুর বলিয়া বোধ হইল। পিতার ষড়্‌যন্ত্রপ্রবণ নিষ্ঠুর নীতির বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে তিনি পিতার সমক্ষেই আপন মত স্পষ্ট ব্যক্ত করিতেন এবং কখনো কখনো তিনি সম্রাটের বিরাগভাজ হইতেন। আজ তিনি তাঁহার সৈন্যাধ্যক্ষদের মধ্যে কয়েকজন প্রধান প্রধান ব্যক্তিকে ডাকিয়া সম্রাটের নিষ্ঠুরতা খলতা ও অত্যাচার সম্বন্ধে বিরাগ প্রকাশ করিয়া কহিলেন, “আমি তোণ্ডায় আমার পিতৃব্যের সহিত যোগ দিতে যাইব। তোমরা যাহারা আমাকে ভালোবাস, আমার অনুবর্তী হও।”

তাহারা দীর্ঘ সেলাম করিয়া তৎক্ষণাৎ কহিল, “শাহজাদা যাহা বলিতেছেন তাহা অতি যথার্থ, কালই দেখিবেন অর্ধেক সৈন্য তোণ্ডার শিবিরে শাহজাদার সহিত মিলিত হইবে।”

মহম্মদ সেইদিনই নদী পার হইয়া সুজার শিবিরে উপস্থিত হইলেন।

তোণ্ডায় উৎসব পড়িয়া গেল। যুদ্ধবিগ্রহের কথা সকলে একেবারেই ভুলিয়া গেল। এতদিন কেবল পুরুষেরাই ব্যস্ত ছিল, এখন সুজার পরিবারে রমণীদের হাতেও কাজের অন্ত রহিল না। সুজা অত্যন্ত স্নেহ ও আনন্দের সহিত মহম্মদকে গ্রহণ করিলেন। অবিশ্রাম রক্তপাতের পরে রক্তের টান যেন আরও বাড়িয়া উঠিল। নৃত্যগীতবাদ্যের মধ্যে বিবাহ সম্পন্ন হইয়া গেল। নৃত্যগীত শেষ হইতে না হইতেই সংবাদ আসিল সম্রাট-সৈন্য নিকটবর্তী হইয়াছে।

0 Shares