রাজর্ষি

মহম্মদ যেমনি সুজার শিবিরে গেছেন, সৈন্যেরা অমনি মীর্‌জুমলার নিকট সংবাদ প্রেরণ করিল। একটি সৈন্যও মহম্মদের সহিত যোগ দিল না, তাহারা বুঝিয়াছিল মহম্মদ ইচ্ছাপূর্বক বিপদসাগরে ঝাঁপ দিয়াছেন, সেখানে তাঁহার দলভুক্ত হইতে যাওয়া বাতুলতা।

সুজা এবং মহম্মদের বিশ্বাস ছিল যে, সম্রাট-সৈন্যের অধিকাংশই যুদ্ধক্ষেত্রে কুমার মহম্মদের সহিত যোগ দিবে। এই আশায় মহম্মদ নিজের নিশান উড়াইয়া যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলেন। বৃহৎ একদল সম্রাট-সৈন্য তাঁহার দিকে অগ্রসর হইল। মহম্মদ আনন্দে উৎফুল্ল হইলেন। নিকটে আসিয়াই তাহারা মহম্মদের সৈন্যদলের উপরে গোলা বর্ষণ করিল। তখন মহম্মদ সমস্ত অবস্থা বুঝিতে পারিলেন। কিন্তু তখন আর সময় নাই। সৈন্যেরা পলায়নতৎপর হইল। সুজার জ্যেষ্ঠ পুত্র যুদ্ধে মারা পড়িল।

সেই রাত্রেই হতভাগ্য সুজা এবং তাঁহার জামাতা সপরিবার দ্রুতগামী নৌকায় চড়িয়া ঢাকায় পলায়ন করিলেন। মীর্‌জুমলা ঢাকায় সুজার অনুসরণ করা আবশ্যক বিবেচনা করিলেন না। তিনি বিজিত দেশে শৃঙ্খলাস্থাপনে প্রবৃত্ত হইলেন।

দুর্দশার দিনে বিপদের সময় যখন বন্ধুরা একে একে বিমুখ হইতে থাকে তখন মহম্মদ ধন প্রাণ তুচ্ছ করিয়া সুজার পক্ষাবলম্বন করাতে সুজার হৃদয় বিগলিত হইয়া গেল। তিনি প্রাণের সহিত মহম্মদকে ভালোবাসিলেন। এমন সময়ে ঢাকা শহরে ঔরংজীবের একজন পত্রবাহক চর ধরা পড়িল। সুজার হাতে তাহার পত্র গিয়া পড়িল। ঔরংজীব মহম্মদকে লিখিতেছেন, “প্রিয়তম পুত্র মহম্মদ, তুমি তোমার কর্তব্য অবহেলা করিয়া পিতৃবিদ্রোহী হইয়াছ, এবং তোমার অকলঙ্ক যশে কলঙ্ক নিক্ষেপ করিয়াছ। রমণীর ছলনাময় হাস্যে মুগ্ধ হইয়া আপন ধর্ম বিসর্জন দিয়াছ। ভবিষ্যতে সমস্ত মোগল-সাম্রাজ্য শাসনের ভার যাঁহার হস্তে, তিনি আজ এক রমণীর দাস হইয়া আছেন, যাহা হউক, ঈশ্বরের নামে শপথ করিয়া মহম্মদ যখন অনুতাপ প্রকাশ করিয়াছেন, তখন তাঁহাকে মাপ করিলাম। কিন্তু যে কার্যের জন্য গিয়াছেন সেই কার্য সাধন করিয়া আসিলে তবে তিনি আমাদের অনুগ্রহের অধিকারী হইবেন।”

সুজা এই পত্র পাঠ করিয়া বজ্রাহত হইলেন। মহম্মদ বার বার করিয়া বলিলেন, তিনি কখনোই পিতার নিকটে অনুতাপ প্রকাশ করেন নাই। এ-সমস্তই তাঁহার পিতার কৌশল। কিন্তু সুজার সন্দেহ দূর হইল না। সুজা তিন দিন ধরিয়া চিন্তা করিলেন। অবশেষে চতুর্থ দিনে কহিলেন, “বৎস, আমাদের মধ্যে বিশ্বাসের বন্ধন শিথিল হইয়াছে। অতএব আমি অনুরোধ করিতেছি, তুমি তোমার স্ত্রীকে লইয়া প্রস্থান করো, নহিলে আমাদের মনে আর শান্তি থাকিবে না। আমার রাজকোষের দ্বার মুক্ত করিয়া দিলাম, শ্বশুরের উপহারস্বরূপ যত ইচ্ছা ধনরত্ন লইয়া যাও।”

মহম্মদ অশ্রুবিসর্জন করিয়া বিদায় লইলেন, তাঁহার স্ত্রী তাঁহার সঙ্গে গেলেন।

সুজা কহিলেন, “আর যুদ্ধ করিব না। চট্টগ্রামের বন্দর হইতে জাহাজ লইয়া মক্কায় চলিয়া যাইব।”

বলিয়া ঢাকা ছাড়িয়া ছদ্মবেশে চলিয়া গেলেন।

চতুশ্চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

যে দুর্গে গোবিন্দমাণিক্য বাস করিতেন, একদিন বর্ষার অপরাহ্নে সেই দুর্গের পথে একজন ফকির, সঙ্গে তিনজন বালক ও একজন প্রাপ্তবয়স্ক তলপিদার লইয়া চলিয়াছেন। বালকদের অত্যন্ত ক্লান্ত দেখাইতেছে। বাতাস বেগে বহিতেছে এবং অবিশ্রাম বর্ষার ধারা পড়িতেছে। সকলের চেয়ে ছোটো বালকটির বয়স চৌদ্দর অধিক হইবে না, সে শীতে কাঁপিতে কাঁপিতে কাতর স্বরে কহিল “পিতা, আর তো পারি না।” বলিয়া অধীর ভাবে কাঁদিতে লাগিল।

ফকির কিছু না বলিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া তাহাকে বুকের কাছে টানিয়া লইলেন।

বড়ো বালকটি ছোটোকে তিরস্কার করিয়া কহিল, “পথের মধ্যে এমন করিয়া কাঁদিয়া ফল কী? চুপ কর্‌। অনর্থক পিতাকে কাতর করিস নে।”

ছোটো বালকটি তখন তাহার উচ্ছ্বসিত ক্রন্দন দমন করিয়া শান্ত হইল।

মধ্যম বালকটি ফকিরকে জিজ্ঞাসা করিল, “পিতা, আমরা কোথায় যাইতেছি?”

ফকির কহিলেন, “ঐ যে দুর্গের চূড়া দেখা যাইতেছে, ঐ দুর্গে যাইতেছি।”

“ওখানে কে আছে পিতা?”

“শুনিয়াছি কোথাকার একজন রাজা সন্ন্যাসী হইয়া ওখানে বাস করেন।”

“রাজা সন্ন্যাসী কেন হইল পিতা?”

ফকির কহিলেন, “জানি না বাছা। হয়তো তাঁহার আপনার সহোদর ভ্রাতা সৈন্য লইয়া তাঁহাকে একটা গ্রাম্য কুকুরের মতো দেশ হইতে দেশান্তরে তাড়া করিয়াছে। রাজ্য ও সুখসম্পদ হইতে তাঁহাকে পথে বাহির করিয়া দিয়াছে। এখন হয়তো কেবল দারিদ্র৻ের অন্ধকার ক্ষুদ্র গহ্বর ও সন্ন্যাসীর গেরুয়া বসন পৃথিবীর মধ্যে তাঁহার একমাত্র লুকাইবার স্থান। আপনার ভ্রাতার বিদ্বেষ হইতে, বিষদন্ত হইতে, আর কোথাও রক্ষা নাই।”

বলিয়া ফকির দৃঢ়রূপে আপন ওষ্ঠাধর চাপিয়া হৃদয়ের আবেগ দমন করিলেন। বড়ো ছেলেটি জিজ্ঞাসা করিল, “পিতা, এই সন্ন্যাসী কোন্‌ দেশের রাজা ছিল?

ফকির কহিলেন, “তাহা জানি না বাছা।”

“যদি আমাদের আশ্রয় না দেয়?”

“তবে আমরা বৃক্ষতলে শয়ন করিব। আর আমাদের স্থান কোথায়?”

সন্ধ্যার কিছু পূর্বে দুর্গে সন্ন্যাসী ও ফকিরে দেখা হইল। উভয়েই উভয়কে দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেলেন। গোবিন্দমাণিক্য চাহিয়া দেখিলেন, ফকিরকে ফকির বলিয়া বোধ হইল না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থপর বাসনা হইতে হৃদয়কে প্রত্যাহরণ করিয়া একমাত্র বৃহৎ উদ্দেশ্যের মধ্যে স্থাপন করিলে মুখে যে একপ্রকার জ্বালাবিহীন বিমল জ্যোতি প্রকাশ পায়, ফকিরের মুখে তাহা দেখিতে পাইলেন না। ফকির সর্বদা সতর্ক, সচকিত। তাঁহার হৃদয়ের তৃষিত বাসনাসকল তাঁহার দুই জ্বলন্ত নেত্র হইতে যেন অগ্নি পান করিতেছে। অধীর হিংসা তাঁহার দৃঢ়বদ্ধ ওষ্ঠাধর এবং দৃঢ়লগ্ন দন্তের মধ্যে বিফলে প্রতিহত হইয়া পুনরায় যেন হৃদয়ের অন্ধকার গহ্বরে প্রবেশ করিয়া আপনাকে আপনি দংশন করিতেছে। সঙ্গে তিনজন বালক, তাহাদের অত্যন্ত সুকুমার সুন্দর শ্রান্ত ক্লিষ্ট দেহ ও একপ্রকার গর্বিত সংকোচ দেখিয়া মনে হইল যেন তাহারা আজন্মকাল অতি সযত্নে সম্মানের শিকার উপরে তোলা ছিল, এই প্রথম তাহাদের ভূমিতলে পদার্পণ। চলিতে গেলে যে চরণের অঙ্গুলিতে ধূলি লাগে, ইহা যেন পূর্বে তাহাদের প্রত্যক্ষ জানা ছিল না। পৃথিবীর এই ধূলিময় মলিন দারিদ্র৻ে প্রতিপদে যেন পৃথিবীর উপরে তাহাদের ঘৃণা জন্মিতেছে, মছলন্দ ও মাটির প্রভেদ দেখিয়া প্রতিপদে তাহারা যেন পৃথিবীকে তিরস্কার করিতেছে। পৃথিবী যেন তাহাদেরই প্রতি বিশেষ আড়ি করিয়া আপনার বড়ো মছলন্দখানা গুটাইয়া রাখিয়াছে। সকলেই যেন তাহাদের নিকটে অপরাধ করিতেছে। দরিদ্র যে ভিক্ষা করিবার জন্য তাহার মলিন বসন লইয়া তাহাদের কাছে ঘেঁষিতে সাহস করিতেছে এ কেবল তাহার স্পর্ধা; ঘৃণ্য কুকুর পাছে কাছে আসে এইজন্য লোকে যেমন খাদ্যখণ্ড দূর হইতে ছুঁড়িয়া দেয়, ইহারাও যেন তেমনি ক্ষুধার্ত মলিন ভিক্ষুককে দেখিলে দূর হইতে মুখ ফিরাইয়া এক মুঠা মুদ্রা অনায়াসে ফেলিয়া দিতে পারে। তাহাদের চক্ষে অধিকাংশ পৃথিবীর একপ্রকার যৎসামান্য ভাব ও ছিন্নবস্ত্র অকিঞ্চনতা যেন কেবল একটা মস্ত বেয়াদবি। তাহারা যে পৃথিবীতে সুখী ও সম্মানিত হইতেছে না এ কেবল পৃথিবীর দোষ।

0 Shares