রাজর্ষি

রাজা কিঞ্চিৎ ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “নক্ষত্রের নিকট হইতে আসিতেছ ঠাকুর? বিশেষ কোনো সংবাদ আছে?”

রঘুপতি কহিলেন, “নক্ষত্ররায় ভালো আছেন, তাঁহার জন্য ভাবিবেন না।”

আকাশের দিকে হাত তুলিয়া কহিলেন, “আমাকে জয়সিংহ তোমার কাছে পাঠাইয়া দিয়াছে। সে বাঁচিয়া নাই। তাহার ইচ্ছা আমি সাধন করিব, নহিলে আমার শান্তি নাই। তোমার কাছে থাকিয়া তোমার সঙ্গী হইয়া তোমার সকল কার্যে আমি যোগ দিব।”

রাজা প্রথমে রঘুপতির ভাব কিছু বুঝিতে পারিলেন না। তিনি একবার মনে করিলেন, রঘুপতি বুঝি পাগল হইয়া থাকিবেন। রাজা চুপ করিয়া রহিলেন।

রঘুপতি কহিলেন, “আমি সমস্ত দেখিয়াছি, কিছুতেই সুখ নাই। হিংসা করিয়া সুখ নাই, আধিপত্য করিয়া সুখ নাই, তুমি যে পথ অবলম্বন করিয়াছ তাহাতেই সুখ। আমি তোমার পরম শত্রুতা করিয়াছি, আমি তোমাকে হিংসা করিয়াছি, তোমাকে আমার কাছে বলি দিতে চাহিয়াছিলাম, আজ আমাকে তোমার কাছে সম্পূর্ণ ত্যাগ করিতে আসিয়াছি।”

গোবিন্দমাণিক্য কহিলেন, “ঠাকুর, তুমি আমার পরম উপকার করিয়াছ। আমার শত্রু আমার ছায়ার মতো আমার সঙ্গে সঙ্গেই লিপ্ত হইয়া ছিল, তাহার হাত হইতে তুমি আমাকে পরিত্রাণ করিয়াছ।”

রঘুপতি সে কথায় বড়ো-একটা কান না দিয়া কহিলেন, “মহারাজ, আমি জগতের রক্তপাত করিয়া যে পিশাচীকে এতকাল সেবা করিয়া আসিয়াছি, সে অবশেষে আমারই হৃদয়ের সমস্ত রক্ত শোষণ করিয়া পান করিয়াছে। সেই শোণিতপিপাসী জড়তা-মূঢ়তাকে আমি দূর করিয়া আসিয়াছি; সে এখন মহারাজের রাজ্যের দেবমন্দিরে নাই, এখন সে রাজসভায় প্রবেশ করিয়া সিংহাসনে চড়িয়া বসিয়াছে।”

রাজা কহিলেন, “দেবমন্দির হইতে যদি সে দূর হয় তো ক্রমে মানবের হৃদয় হইতেও দূর হইতে পারিবে।”

পশ্চাৎ হইতে একটি পরিচিত স্বর কহিল, “না, মহারাজ, মানবহৃদয়ই প্রকৃত মন্দির, সেইখানেই খড়্‌গ শাণিত হয় এবং সেইখানেই শত সহস্র নরবলি হয়। দেব-মন্দিরে তাহার সামান্য অভিনয় হয় মাত্র।”

রাজা সচকিত হইয়া ফিরিয়া দেখিলেন সহাস্য সৌম্যমূর্তি বিল্বন। তাঁহাকে প্রণাম করিয়া রুদ্ধকণ্ঠে কহিলেন, “আজ আমার কী আনন্দ।”

বিল্বন কহিলেন, “মহারাজ, আপনাকে জয় করিয়াছেন বলিয়া সকলকেই জয় করিয়াছেন। তাই আজ আপনার দ্বারে শত্রুমিত্র সকলে একত্র হইয়াছে।”

ফকির অগ্রসর হইয়া কহিলেন, “মহারাজ, আমিও তোমার শত্রু, আমিও তোমার হাতে ধরা দিলাম।”

রঘুপতির দিকে আঙুলি নির্দেশ করিয়া কহিলেন, “এই ব্রাহ্মণ-ঠাকুর আমাকে জানেন। আমিই সুজা, বাংলার নবাব, আমিই তোমাকে বিনাপরাধে নির্বাসিত করিয়াছি এবং সে পাপের শাস্তিও পাইয়াছি– আমার ভ্রাতার হিংসা আজ পথে পথে আমার অনুসরণ করিতেছে, আমার রাজ্যে আমার আর দাঁড়াইবার স্থান নাই। ছদ্মবেশে আমি আর থাকিতে পারি না তোমার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করিয়া আমি বাঁচিলাম।”

তখন রাজা ও নবাব উভয়ে কোলাকুলি করিলেন। রাজা কেলবমাত্র কহিলেন, “আমার কী সৌভাগ্য!”

রঘুপতি কহিলেন, “মহারাজ, তোমার সহিত শত্রুতা করিলেও লাভ আছে। তোমার শত্রুতা করিতে গিয়াই তোমার কাছে ধরা পড়িয়াছি, নহিলে কোনোকালে তোমাকে জানিতাম না।”

বিল্বন হাসিয়া কহিলেন, “যেমন ফাঁসের মধ্যে পড়িয়া ফাঁস ছিঁড়িতে গিয়া গলায় আরও অধিক বাধিয়া যায়।”

রঘুপতি কহিলেন, “আমার আর দুঃখ নাই– আমি শান্তি পাইয়াছি।”

বিল্বন কহিলেন, “শান্তি সুখ আপনার মধ্যেই আছে, কেবল জানিতে পাই না। ভগবান এ যেন মাটির হাঁড়িতে অমৃত রাখিয়াছেন, অমৃত আছে বলিয়া কাহারও বিশ্বাস হয় না। আঘাত লাগিয়া হাঁড়ি ভাঙিলে তবে অনেক সময়ে সুধার আস্বাদ পাই। হায় হায়, এমন জিনিসও এমন জায়গায় থাকে!”

এমন সময়ে একটা অভ্রভেদী হো হো শব্দ উঠিল। দেখিতে দেখিতে দুর্গের মধ্যে ছোটোবড়ো নানাবিধ ছেলে আসিয়া পড়িল। রাজা বিল্বনকে কহিলেন, “এই দেখো ঠাকুর, আমার ধ্রুব।”

বলিয়া ছেলেদের দেখাইয়া দিলেন।

বিল্বন কহিলেন, “যাহার প্রসাদে তুমি এতগুলি ছেলে পাইয়াছ সেও তোমাকে ভোলে নাই, তাহাকেও আনিয়া দিই।”

বলিয়া বাহিরে গেলেন। কিঞ্চিৎ বিলম্বে ধ্রুবকে কোলে করিয়া আনিয়া রাজার কোলে দিলেন। রাজা তাহাকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া ডাকিলেন, “ধ্রুব!”

ধ্রুব কিছুই বলিল না, গম্ভীর ভাবে নীরবে রাজার কাঁধে মাথা দিয়া পড়িয়া রহিল। বহুদিন পরে প্রথম মিলনে বালকের ক্ষুদ্র হৃদয়ের মধ্যে যেন একপ্রকার অস্ফুট অভিমান ও লজ্জার উদয় হইল। রাজাকে জড়াইয়া মুখ লুকাইয়া রহিল।

রাজা বলিলেন, “আর সব হইল, কেবল নক্ষত্র আমাকে ভাই বলিল না।”

সুজা তীব্রভাবে কহিলেন, “মহারাজ, আর সকলেই অতি সহজেই ভাইয়ের মতো ব্যবহার করে, কেবল নিজের ভাই করে না।”

সুজার হৃদয় হইতে এখনো শেল উৎপাটিত হয় নাই।

উপসংহার

এইখানে বলা আবশ্যক তিনটি বালক সুজার তিন ছদ্মবেশী কন্যা। সুজা মক্কা যাইবার উদ্দেশে চট্টগ্রাম বন্দরে গিয়াছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে গুরুতর বর্ষার প্রাদুর্ভাবে একখানিও জাহাজ পাইলেন না। অবশেষে হতাশ হইয়া ফিরিয়া আসিবার পথে, গোবিন্দমাণিক্যের সহিত দুর্গে দেখা হয়। কিছুদিন দুর্গে বাস করিয়া সুজা সংবাদ পাইলেন এখনো সম্রাট-সৈন্য তাঁহাকে সন্ধান করিতেছে। গোবিন্দমাণিক্য যানাদি ও বিস্তর অনুচর-সমেত তাঁহার বন্ধু আরাকান-পতির নিকটে তাঁহাকে প্রেরণ করেন। যাইবার সময় সুজা তাঁহাকে বহুমূল্য তরবারি উপহারস্বরূপ দান করেন।

0 Shares