রীতিমত নভেল

কিন্তু হে পাঠক, সে প্রশ্নের উত্তর আমি দিব না। কুমারীর নিভৃত হৃদয়মন্দিরের মধ্যে আজি এই নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় কোন্‌ মর্ত্যদেবতার আরতি হইতেছে, অপবিত্র কৌতূহল লইয়া সেখানে প্রবেশ করিতে পারিব না। ঐ দেখো, একটি দীর্ঘনিশ্বাস পূজার সুগন্ধি ধূপধূমের ন্যায় সন্ধ্যার বাতাসে মিশাইয়া গেল এবং দুইফোঁটা অশ্রুজল দুটি সুকোমল কুসুমকোরকের মতো অজ্ঞাত দেবতার চরণের উদ্দেশে খসিয়া পড়িল।

এমন সময় পশ্চাৎ হইতে একটি পুরুষের কণ্ঠ গভীর আবেগভরে কম্পিত রুদ্ধস্বরে বলিয়া উঠিল, ‘রাজকুমারী।’

রাজকন্যা সহসা ভয়ে চীৎকার করিয়া উঠিলেন। চারি দিক হইতে প্রহরী ছুটিয়া আসিয়া অপরাধীকে বন্দী করিল। রাজকন্যা তখন পুনরায় সসংজ্ঞ হইয়া দেখিলেন, সেনাপতি বন্দী হইয়াছেন।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

এ অপরাধে প্রাণদণ্ডই বিধান। কিন্তু পূর্বোপকার স্মরণ করিয়া রাজা তাঁহাকে নির্বাসিত করিয়া দিলেন। সেনাপতি মনে মনে কহিলেন, ‘দেবী, তোমার নেত্রও যখন প্রতারণা করিতে পারে, তখন সত্য পৃথিবীতে কোথাও নাই। আজ হইতে আমি মানবের শত্রু।’ একটি বৃহৎ দস্যুদলের অধিপতি হইয়া ললিতসিংহ অরণ্যে বাস করিতে লাগিলেন।

হে পাঠক, তোমার আমার মতো লোক এইরূপ ঘটনায় কী করিত। নিশ্চয় যেখানে নির্বাসিত হইত সেখানে আর-একটা চাকরির চেষ্টা দেখিত, কিম্বা একটা নূতন খবরের কাগজ বাহির করিত। কিছু কষ্ট হইত সন্দেহ নাই– সে অন্নাভাবে। কিন্তু সেনাপতির মতো মহৎ লোক, যাহারা উপন্যাসে সুলভ এবং পৃথিবীতে দুর্লভ, তাহারা চাকরিও করে না, খবরের কাগজও চালায় না। তাহারা যখন সুখে থাকে তখন একনিশ্বাসে নিখিলজগতের উপকার করে এবং মনোবাঞ্ছা তিলমাত্র ব্যর্থ হইলেই আরক্তলোচনে বলে, ‘রাক্ষসী পৃথিবী, পিশাচ সমাজ, তোদের বুকে পা দিয়া আমি ইহার প্রতিশোধ লইব।’ বলিয়া তৎক্ষণাৎ দস্যুব্যবসায় আরম্ভ করে। এইরূপ ইংরেজি কাব্যে পড়া যায় এবং অবশ্যই এ প্রথা রাজপুতদের মধ্যে প্রচলিত ছিল।

দস্যুর উপদ্রবে দেশের লোক ত্রস্ত হইয়া উঠিল। কিন্তু এই অসামান্য দস্যুরা অনাথের সহায়, দরিদ্রের বন্ধু, দুর্বলের আশ্রয়, কেবল, ধনী উচ্চকুলজাত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি এবং রাজকর্মচারীদের পক্ষে কালান্তক যম।

ঘোর অরণ্য, সূর্য অস্তপ্রায়। কিন্তু বনচ্ছায়ায় অকালরাত্রির আবির্ভাব হইয়াছে।

তরুণ যুবক অপরিচিত পথে একাকী চলিতেছে! সুকুমার শরীর পথশ্রমে ক্লান্ত, কিন্তু তথাপি অধ্যবসায়ের বিরাম নাই। কটিদেশে যে তরবারি বদ্ধ রহিয়াছে, তাহারই ভার দুঃসহ বোধ হইতেছে। অরণ্যে লেশমাত্র শব্দ হইলেই ভয়প্রবণ হৃদয় হরিণের মতো চকিত হইয়া উঠিতেছে। কিন্তু তথাপি এই আসন্ন রাত্রি এবং অজ্ঞাত অরণ্যের মধ্যে দৃঢ় সংকল্পের সহিত অগ্রসর হইতেছে।

দস্যুরা আসিয়া দস্যুপতিকে সংবাদ দিল, ‘মহারাজ, বৃহৎ শিকার মিলিয়াছে। মাথায় মুকুট, রাজবেশ, কটিদেশে তরবারি।’

দস্যুপতি কহিলেন, ‘তবে এ শিকার আমার। তোরা এখানেই থাক্‌।’

পথিক চলিতে চলিতে সহসা একবার শুষ্ক পত্রের খস্‌খস্‌ শব্দ শুনিতে পাইল। উৎকন্ঠিত হইয়া চারি দিকে চাহিয়া দেখিল।

সহসা বুকের মাঝখানে তীর আসিয়া বিঁধিল, পান্থ ‘মা’ বলিয়া ভূতলে পড়িয়া গেল।

দস্যুপতি নিকটে আসিয়া জানু পাতিয়া নত হইয়া আহতের মুখের দিকে নিরীক্ষণ করিলেন। ভূতলশায়ী পথিক দস্যুর হাত ধরিয়া কেবল একবার মৃদুস্বরে কহিল, ‘ললিত।’

মুহূর্তে দস্যুর হৃদয় যেন সহস্র খণ্ডে ভাঙিয়া এক চীৎকারশব্দ বাহির হইল, ‘রাজকুমারী।’

দস্যুরা আসিয়া দেখিল শিকার এবং শিকারী উভয়েই অন্তিম আলিঙ্গনে বদ্ধ হইয়া মৃত পড়িয়া আছে।

রাজকুমারী একদিন সন্ধ্যাকালে তাঁহার অন্তঃপুরের উদ্যানে অজ্ঞানে ললিতের উপর রাজদণ্ড নিক্ষেপ করিয়াছিলেন, ললিত আর-একদিন সন্ধ্যাকালে অরণ্যের মধ্যে অজ্ঞানে রাজকন্যার প্রতি শর নিক্ষেপ করিল। সংসারের বাহিরে যদি কোথাও মিলন হইয়া থাকে তো আজ উভয়ের অপরাধ উভয়ে বোধ করি মার্জনা করিয়াছে।

0 Shares