শাস্তি

চন্দরা জজের কাছে কহিল, ‘ওগো সাহেব, এক কথা আর বারবার কতবার করিয়া বলিব।’

জজসাহেব তাহাকে বুঝাইয়া বলিলেন, ‘তুমি যে অপরাধ স্বীকার করিতেছ তাহার শাস্তি কী জানা?’

চন্দরা কহিল, ‘না।’

জজসাহেব কহিলেন, ‘তাহার শাস্তি ফাঁসি।’

চন্দরা কহিল, ‘ওগো তোমার পায়ে পড়ি তাই দাওনা সাহেব। তোমাদের যাহা খুশি করো, আমার তো আর সহ্য হয় না।’

যখন ছিদামকে আদালতে উপস্থিত করিল, চন্দরা মুখ ফিরাইল। জজ কহিলেন, ‘সাক্ষীর দিকে চাহিয়া বলো এ তোমার কে হয়।’

চন্দরা দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া কহিল, ‘ও আমার স্বামী হয়।’

প্রশ্ন হইল–ও তোমাকে ভালোবাসে না?

উত্তর। উঃ ভারি ভালোবাসে।

প্রশ্ন। তুমি উহাকে ভালোবাস না?

উত্তর। খুব ভালোবাসি।

ছিদামকে যখন প্রশ্ন হইল, ছিদাম কহিল, ‘আমি খুন করিয়াছি।’

প্রশ্ন। কেন।

ছিদাম। ভাত চাহিয়াছিলাম বড়োবউ ভাত দেয় নাই।

দুখিরাম সাক্ষ্য দিতে আসিয়া, মূর্ছিত হইয়া পড়িল। মূর্ছাভঙ্গের পর উত্তর করিল, ‘সাহেব, খুন আমি করিয়াছি।’

কেন।

ভাত চাহিয়াছিলাম ভাত দেয় নাই।

বিস্তর জেরা করিয়া এবং অন্যান্য সাক্ষ্য শুনিয়া জজসাহেব স্পষ্ট বুঝিতে পারিলেন, ঘরের স্ত্রীলোককে ফাঁসির অপমান হইতে বাঁচাইবার জন্য ইহারা দুই ভাই অপরাধ স্বীকার করিতেছে। কিন্তু চন্দরা পুলিস হইতে সেশন আদালত পর্যন্ত বরাবর এককথা বলিয়া আসিতেছে, তাহার কথার তিলমাত্র নড়চড় হয় নাই। দুইজন উকিল স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত হইয়া তাহাকে প্রাণদণ্ড হইতে রক্ষা করিবার জন্য বিস্তর চেষ্টা করিয়াছে, কিন্তু অবশেষে তাহার নিকট পরাস্ত মানিয়াছে।

যেদিন একরত্তি বয়সে একটি কালোকোলো ছোটোখাটো মেয়ে তাহার গোলগাল মুখটি লইয়া খেলার পুতুল ফেলিয়া বাপের ঘর হইতে শ্বশুরঘরে আসিল, সেদিন রাত্রে শুভলগ্নের সময় আজিকার দিনের কথা কে কল্পনা করিতে পারিত। তাহার বাপ মরিবার সময় এই বলিয়া নিশ্চিন্ত হইয়াছিল যে, যাহা হউক আমার মেয়েটির একটি সদগতি করিয়া গেলাম।

জেলখানায় ফাঁসির পূর্বে দয়ালু সিভিল সার্জন চন্দরাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কাহাকেও দেখিতে ইচ্ছা কর?’

চন্দরা কহিল, ‘একবার আমার মাকে দেখিতে চাই।’

ডাক্তার কহিল ‘তোমার স্বামী তোমাকে দেখিতে চায়, তাহাকে কি ডাকিয়া আনিব।’

চন্দরা কহিল, ‘মরণ।–‘

0 Shares