শেষের কবিতা

টেবিলে প্রবল চাপড় দিতে দিতে উচ্চৈঃস্বরে অমিত বললে, “থাকবে, থাকবে থাকবে।”

যোগমায়া পাশের ঘর থেকে তাড়াতাড়ি এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী থাকবে অমিত। আমার টেবিলটা বোধ হচ্ছে থাকবে না।”

“জগতে যা-কিছু টেকসই সবই থাকবে। সংসারে নববধূ দুর্লভ, কিন্তু লাখের মধ্যে একটি যদি দৈবাৎ পাওয়া যায়, সে চিরদিনই থাকবে নববধূ।”

“একটা দৃষ্টান্ত দেখাও দেখি।”

“একদিন সময় আসবে, দেখাব।”

“বোধ হচ্ছে তার কিছু দেরি আছে, ততক্ষণ খেতে চলো।”

১২

আহার শেষ হলে অমিত বললে, “কাল কলকাতায় যাচ্ছি মাসিমা। আমার আত্মীয়স্বজন সবাই সন্দেহ করছে আমি খাসিয়া হয়ে গেছি।

“আত্মীয়স্বজনেরা কি জানে, কথায় কথায় তোমার এত বদল সম্ভব।”

“খুব জানে। নইলে আত্মীয়স্বজন কিসের। তাই বলে কথায় কথায় নয়, আর খাসিয়া হওয়া নয়। যে বদল আজ আমার হল এ কি জাত-বদল। এ যে যুগ-বদল! তার মাঝখানে একটা কল্পান্ত। প্রজাপতি জেগে উঠেছেন আমার মধ্যে এক নূতন সৃষ্টিতে। মাসিমা, অনুমতি দাও, লাবণ্যকে নিয়ে আজ একবার বেড়িয়ে আসি। যাবার আগে শিলঙ পাহাড়কে আমাদের যুগল প্রণাম জানিয়ে যেতে চাই।”

যোগমায়া সম্মতি দিলেন। কিছুদূরে যেতে যেতে দুজনের হাত মিলে গেল, ওরা কাছে কাছে এল ঘেঁষে। নির্জন পথের ধারে নীচের দিকে চলেছে ঘন বন। সেই বনের একটা জায়গায় পড়েছে ফাঁক, আকাশ সেখানে পাহাড়ের নজরবন্দি থেকে একটুখানি ছুটি পেয়েছে; তার অঞ্জলি ভরিয়ে নিয়েছে অস্তসূর্যের শেষ আভায়। সেইখানে পশ্চিমের দিকে মুখ করে দুজনে দাঁড়াল। অমিত লাবণ্যর মাথা বুকে টেনে নিয়ে তার মুখটি উপরে তুলে ধরলে। লাবণ্যর চোখ অর্ধেক বোজা, কোণ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আকাশে সোনার রঙের উপর চুনি-গলানো পান্না-গলানো আলোর আভাসগুলি মিলিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে; মাঝে মাঝে পাতলা মেঘের ফাঁকে ফাঁকে সুগভীর নির্মল নীল, মনে হয় তার ভিতর দিয়ে, যেখানে দেহ নেই শুধু আনন্দ আছে সেই অমর্তজগতের অব্যক্ত ধ্বনি আসছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার হল ঘন। সেই খোলা আকাশটুকু, রাত্রিবেলায় ফুলের মতো, নানা রঙের পাপড়িগুলি বন্ধ করে দিলে।

অমিতর বুকের কাছ থেকে লাবণ্য মৃদুস্বরে বললে, “চলো এবার।” কেমন তার মনে হল, এইখানে শেষ করা ভালো।

অমিত সেটা বুঝলে, কিছু বললে না। লাবণ্যর মুখ বুকের উপর একবার চেপে ধরে ফেরবার পথে খুব ধীরে ধীরে চলল।

বললে, “কাল সকালেই আমাকে ছাড়তে হবে। তার আগে আর দেখা করতে আসব না।”

“কেন আসবে না।”

“আজ ঠিক জায়গায় আমাদের শিলঙ পাহাড়ের অধ্যায়টি এসে থামল–ইতি প্রথমঃ সর্গঃ, আমাদের সয়ে-বয়ে স্বর্গ।”

লাবণ্য কিছু বললে না, অমিতর হাত ধরে চলল। বুকের ভিতর আনন্দ, আর তারই সঙ্গে সঙ্গে একটা কান্না স্তব্ধ হয়ে আছে। মনে হল, জীবনে কোনোদিন এমন নিবিড় করে অভাবনীয়কে এত কাছে পাওয়া যাবে না। পরম ক্ষণে শুভদৃষ্টি হল, এর পরে আর কি বাসরঘর আছে। রইল কেবল মিলন আর বিদায় একত্র মিশিয়ে একটি শেষ প্রণাম। ভারি ইচ্ছে করতে লাগল অমিতকে এখনই প্রণামটি করে; বলে, তুমি আমাকে ধন্য করেছ। কিন্তু সে আর হল না।

বাসার কাছাকাছি আসতেই অমিত বললে, “বন্যা, আজ তোমার শেষ কথাটি একটি কবিতায় বলো, তা হলে সেটা মনে করে নিয়ে যাওয়া সহজ হবে। তোমার নিজের যা মনে আছে এমন একটা-কিছু আমাকে শুনিয়ে দাও।”

লাবণ্য একটুখানি ভেবে আবৃত্তি করলে–

“তোমারে দিই নি সুখ, মুক্তির নৈবেদ্য গেনু রাখি

রজনীর শুভ্র অবসানে। কিছু আর নাই বাকি,

নাইকো প্রার্থনা, নাই প্রতি মুহূর্তের দৈন্যরাশি,

নাই অভিমান, নাই দীন কান্না, নাই গর্ব-হাসি,

নাই পিছু ফিরে দেখা। শুধু সে মুক্তির ডালিখানি

ভরিয়া দিলাম আজি আমার মহৎ মৃত্যু আনি।”

“বন্যা, বড়ো অন্যায় করলে। আজকের দিনে তোমার মুখে বলবার কথা এ নয়, কিছুতেই নয়। কেন এটা তোমার মনে এল। তোমার এ কবিতা এখনই ফিরিয়ে নাও।”

“ভয় কিসের মিতা। এই আগুনে-পোড়া প্রেম, এ সুখের দাবি করে না, এ নিজে মুক্ত বলেই মুক্তি দেয়, এর পিছনে ক্লান্তি আসে না, ম্লানতা আসে না–এর চেয়ে আর কিছু কি দেবার আছে।”

“কিন্তু আমি জানতে চাই, এ কবিতা তুমি পেলে কোথায়।”

“রবি ঠাকুরের।”

“তার তো কোনো বইয়ে এটা দেখি নি।”

“বইয়ে বেরোয় নি।”

“তবে পেলে কী করে।”

“একটি ছেলে ছিল, সে আমার বাবাকে গুরু বলে ভক্তি করত। বাবা দিয়েছিলেন তাকে তার জ্ঞানের খাদ্য, এ দিকে তার হৃদয়টিও ছিল তাপস। সময় পেলেই সে যেত রবি ঠাকুরের কাছে, তাঁর খাতা থেকে মুষ্টিভিক্ষা করে আনত।”

“আর নিয়ে এসে তোমার পায়ে দিত।”

“সে সাহস তার ছিল না। কোথাও রেখে দিত, যদি আমার দৃষ্টিতে পড়ে, যদি আমি তুলে নিই।”

“তাকে দয়া করেছ?”

“করবার অবকাশ হল না। মনে মনে প্রার্থনা করি,ঈশ্বর যেন তাকে দয়া করেন।”

“যে কবিতাটি আজ তুমি পড়লে, বেশ বুঝতে পারছি, এটা সেই হতভাগারই মনের কথা।”

“হাঁ, তারই কথা বইকি।”

“তবে তোমার কেন আজ ওটা মনে পড়ল।”

“কেমন করে বলব। ঐ কবিতাটির সঙ্গে আর-এক টুকরো কবিতা ছিল, সেটাও আজ আমার কেন মনে পড়ছে ঠিক বলতে পারি নে–

সুন্দর, তুমি চক্ষু ভরিয়া

এনেছ অশ্রুজল।

এনেছ তোমার বক্ষে ধরিয়া

দুঃসহ হোমানল।

দুঃখ যে তার উজ্জ্বল হয়ে উঠে,

মুগ্ধ প্রাণের আবেশ-বন্ধ টুটে।

এ তাপে শ্বসিয়া উঠে বিকশিয়া

বিচ্ছেদশতদল।”

অমিত লাবণ্যর হাত চেপে ধরে বললে, “বন্যা, সে ছেলেটা আজ আমাদের মাঝখানে কেন এসে পড়ল। ঈর্ষা করতে আমি ঘৃণা করি, এ আমার ঈর্ষা নয়। কিন্তু কেমন একটা ভয় আসছে মনে। বলো, তার দেওয়া ঐ কবিতাগুলো আজই কেন তোমার এমন করে মনে পড়ে গেল।”

“একদিন সে যখন আমাদের বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল তার পরে যেখানে বসে সে লিখত সেই ডেস্কে এই কবিতাদুটি পেয়েছি। এর সঙ্গে রবি ঠাকুরের আরো অনেক অপ্রকাশিত কবিতা, প্রায় এক খাতা ভরা। আজ তোমার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি, হয়তো সেইজন্যেই বিদায়ের কবিতা মনে হল।”

0 Shares