শেষের রাত্রি

‘একি,বউ,কোথাও যাচ্ছ না কি ।’

‘সীতারামপুরে যাব ।’

সে কী কথা । কার সঙ্গে যাবে ।’

‘অনাথ নিয়ে যাচ্ছে ।’

‘লক্ষী মা আমার , তুমি যেয়ো , আমি তোমাকে বারণ করব না, কিন্তু আজ নয় ।’

‘টিকিট কিনে গাড়ি রিজার্ভ করা হয়ে গেছে ।’

‘তা হোক,ও লোকসান গায়ে সইবে –তুমি কাল সক্কালেই চলে যেয়ো– আজ যেয়ো না ।’

‘মাসি,আমি তোমাদের তিথি বার মানি নে,আজ গেলে দোষ কী ।’

‘যতীন তোমাকে ডেকেছে, তোমার সঙ্গে তার একটু কথা আছে ।’

‘বেশ তো,এখনো একটু সময় আছে, আমি তাঁকে ব’লে আসছি ।’

‘না,তুমি বলতে পারবে না যে যাচ্ছ ।’

‘তা বেশ,কিছু বলব না, কিন্তু আমি দেরি করতে পারব না । কালই অন্নপ্রাশন-আজ যদি না যাই তো চলবে না ।’

‘আমি জোড়হাত করছি, বউ, আমার কথা আজ একদিনের মতো রাখো । আজ মন একটু শান্ত করে যতীনের কাছে এসে বসো– তাড়াতাড়ি কোরো না।’

‘তা,কী করব বলো,গাড়ি তো আমার জন্যে বসে থাকবে না । অনাথ চলে গেছে– দশ মিনিট পরেই সে এসে আমাকে নিয়ে যাবে। এই বেলা তাঁর সঙ্গে দেখা সেরে আসি গে।’

‘না, তবে থাক– তুমি যাও । এমন করে তার কাছে যেতে দেব না । ওরে অভাগিনী, তুই যাকে এত দুঃখ দিলি সে তো সব বির্সজন দিয়ে আজ বাদে কাল চলে যাবে– কিন্তু যত দিন বেঁচে থাকবি এ দিনের কথা তোকে চিরদিন মনে রাখতে হবে– ভগবান আছেন, ভগবান আছেন,সে কথা একদিন বুঝবি ।’

‘মাসি,তুমি অমন ক’রে শাপ দিয়ো না বলছি !’

‘ওরে বাপরে, আর কেন বেঁচে আছিস রে বাপ। পাপের যে শেষ নেই– আমি আর ঠেকিয়ে রাকতে পারলুম না।’

মাসি একটু দেরি করিয়া রোগীর ঘরে গেলেন। আশা করিলেন, যতীন ঘুমাইয়া পড়িবে। কিন্তু ঘরে ঢুকিতেই দেখিলেন, বিছানার উপর যতীন নড়িয়া-চড়িয়া উঠিল। মাসি বলিলেন, ‘এই এক কাণ্ড ক’রে বসেছে।’

‘কী হয়েছে। মণি এল না ? এত দেরি করলে কেন,মাসি।’

‘গিয়ে দেখি, সে তোমার দুধ জ্বাল দিতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছে ব’লে কান্না। আমি বলি,’হয়েছে কী,আরো তো দুধ আছে ।’ কিন্তু, অসাবধান হয়ে তোমার খাবার দুধ পুড়িয়ে ফেলেছে,বউয়ের এ লজ্জা আর কিছুতেই যায় না । আমি তাকে অনেক ক’রে ঠাণ্ডা ক’রে বিছানায় শুইয়ে রেখে এসেছি । আজ আর তাকে আনলুম না । সে একটু ঘুমোক ।’

মণি আসিল না বলিয়া যতীনের বুকের মধ্যে যেমন বাজিল,তেমনি সে আরামও পাইল। তাহার মনে আশঙ্কা ছিল যে, পাছে মণি সশরীরে আসিয়া মণির ধ্যানমাধুরীটুকুর প্রতি জুলুম করিয়া যায় । কেননা,তাহার জীবনে এমন অনেকবার ঘটিয়াছে । দুধ পুড়াইয়া ফেলিয়া মণির কোমল হৃদয় অনুতাপে ব্যথিত হইয়া উঠিয়াছে, ইহারই রসটুকুতে তাহার হৃদয় ভরিয়া উঠিতে লাগিল ।

‘মাসি!’

‘কী,বাবা ।’

‘আমি বেশ জানছি,আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে । কিন্তু , আমার মনে কোনো খেদ নেই । তুমি আমার জন্যে শোক কোরো না ।’

‘না,বাবা,আমি শোক করব না । জীবনেই যে মঙ্গলই আর মরণে যে নয়,এ কথা আমি মনে করি নে ।’

‘মাসি,তোমাকে সত্য বলছি,মৃত্যুকে আমার মধুর মনে হচ্ছে ।’

অন্ধকার আকাশের দিকে তাকাইয়া যতীন দেখিতেছিল,তাহার মণিই আজ মৃত্যুর বেশ ধরিয়া আসিয়া দাঁড়াইয়াছে । সে আজ অক্ষয় যৌবনে পূর্ণ — সে গৃহিণী,সে জননী; সে রূপসী,সে কল্যাণী । তাহারই এলোচুলের উপরে ঐ আকাশের তারাগুলি লক্ষীর স্বহস্তের আর্শীবাদের মালা । তাহাদের দুজনের মাথার উপরে এই অন্ধকারের মঙ্গলবস্ত্রখানি মেলিয়া ধরিয়া আবার যেন নূতন করিয়া শুভদৃষ্টি হইল । রাত্রির এই বিপুল অন্ধকার ভরিয়া গেল মণির অনিমেষ প্রেমের দৃষ্টিপাতে । এই ঘরের বধূ মণি,এই একটুখানি মণি,আজ বিশ্বরূপ ধরিল; জীবনমরণের সংগমতীর্থে ঐ নক্ষত্রবেদীর উপরে সে বসিল ; নিস্তব্ধ রাত্রি মঙ্গলঘটের মতো পুণ্যধারায় ভরিয়া উঠিল । যতীন জোড়হাত করিয়া মনে মনে কহিল,’এতদিনের পর ঘোমটা খুলিল,এই ঘোর অন্ধকারের মধ্যে আবরণ ঘুচিল–অনেক কাঁদাইয়াছ– সুন্দর,হে সুন্দর,তুমি আর ফাঁকি দিতে পারিবে না ।’

0 Shares