শেষের রাত্রি

‘কষ্ট হচ্ছে,মাসি,কিন্তু যত কষ্ট মনে করছ তার কিছুই নয় । আমার সঙ্গে আমার কষ্টের ক্রমশই যেন বিচ্ছেদ হয়ে আসছে । বোঝাই নৌকার মতো এতদিন সে আমার জীবন-জাহাজের সঙ্গে বাঁধা ছিল; আজ যেন বাঁধন কাটা পড়েছে,সে আমার সব বোঝা নিয়ে দূরে ভেসে চলল । এখনো তাকে দেখতে পাচ্ছি,কিন্তু তাকে যেন আর আমার বলে মনে হচ্ছে না– এ দুদিন মণিকে একবারও দেখি নি,মাসি ।’

‘পিঠের কাছে আর-একটা বালিশ দেব কি যতীন ।’

‘আমার মনে হচ্ছে,মাসি,মণিও যেন চলে গেছে । আমার বাঁধন-ছেঁড়া দুঃখের নৌকাটির মতো ।’

‘বাবা,একটু বেদানার রস খাও,তোমার গলা শুকিয়ে আসছে ।’

‘আমার উইলটা কাল লেখা হয়ে গেছে — সে কি আমি তোমাকে দেখিয়েছি– ঠিক মনে পড়ছে না ।’

‘আমার দেখবার দরকার নেই,যতীন ।’

‘মা যখন মারা যান আমার তো কিছুই ছিল না । তোমার খেয়ে তোমার হাতে আমি মানুষ , তাই বলছিলুম–‘

‘সে আবার কী কথা । আমার তো কেবল এই একখানা বাড়ি আর সামান্য কিছু সম্পত্তি ছিল । বাকি সবই তো তোমার নিজের রোজগার ।’

‘কিন্তু এই বাড়িটা–‘

‘কিসের বাড়ি আমার ! কত দালান তুমি বাড়িয়েছ, আমার সেটুকু কোথায় আছে খুঁজেই পাওয়া যায় না ।”

‘মণি তোমাকে ভিতরে ভিতরে খুব–‘

‘সে কি জানি নে, যতীন । তুই এখন ঘুমো ।’

‘আমি মণিকে সব লিখে দিলুম বটে,কিন্তু তোমারই সব রইল,মাসি । ও তো তোমাকে কখনো অমান্য করবে না ।’

‘সে জন্য অত ভাবছ কেন,বাছা ।’

‘তোমার আশীর্বাদেই আমার সব, তুমি আমার উইল দেখে এমন কথা কোনোদিন মনে কোরো না–‘

‘ওকী কথা যতীন । তোমার জিনিস তুমি মণিকে দিয়েছ ব’লে আমি মনে করব ? আমার এমনি পোড়া মন ? তোমার জিনিস ওর নামে লিখে দিয়ে যেতে পারছ বলে তোমার যে-সুখ সেই তো আমার সকল সুখের বেশি,বাপ ।’

‘কিন্তু,তোমাকেও আমি –‘

‘দেখ্‌,যতীন,এইবার আমি রাগ করব । তুই চলে যাবি,আর তুই আমাকে টাকা দিয়ে ভুলিয়ে রেখে যাবি ?’

‘মাসি, টাকার চেয়ে আরো বড়ো যদি কিছু তোমাকে–‘

‘দিয়েছিস, যতীন, ঢের দিয়েছিস। আমার শূন্য ঘর ভ’রে ছিলি, এ আমার অনেক জন্মের ভাগ্য। এতদিন তো বুক ভ’রে পেয়েছি, আজ আমার পাওনা যদি ফুরিয়ে গিয়ে থাকে তো নালিশ করব না। দাও, সব লিখে দাও, লিখে দাও– বাড়িঘর, জিনিসপত্র, ঘোড়াগাড়ি, তালুকমুলুক– যা আছে সব মণির নামে লিখে দাও– এ-সব বোঝা আমার সইবে না।’

‘তোমার ভোগে রুচি নেই– কিন্তু মণির বয়স অল্প, তাই–‘

‘ও কথা বলিস নে, ও কথা বলিস নে। ধনসম্পদ দিতে চাস দে, কিন্তু ভোগ করা–‘

‘কেন ভোগ করবে না, মাসি।’

‘না গো না, পারবে না, পারবে না! আমি বলছি, ওর মুখে রুচবে না! গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে, কিছুতেই কোনো রস পাবে না।’

0 Shares