শেষের রাত্রি

যতীন চুপ করিয়া রহিল। তাহার অভাবে সংসারটা মণির একেবারে বিস্বাদ হইয়া যাইবে, এ কথা সত্য কি মিথ্যা,সুখের কি দুঃখের, তাহা সে যেন ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিল না, আকাশের তারা যেন তাহার হৃদয়ের মধ্যে আসিয়া কানে কানে বলিল, ‘এমনিই বটে– আমরা তো হাজার হাজার বছর হইতে দেখিয়া আসিলাম, সংসার-জোড়া এই-সমস্ত আয়োজন এত-বড়োই ফাঁকি।’

যতীন গভীর একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল,’দেবার মতো জিনিস তো আমরা কিছুই দিয়ে যেতে পারি নে।’

‘কম কী দিয়ে যাচ্ছ, বাছা। এই ঘরবাড়ি টাকাকড়ি ছল ক’রে তুমি ওকে যে কী দিয়ে গেলে তার মূল্য ও কি কোনোদিন বুঝবে না। যা তুমি দিয়েছ তাই মাথা পেতে নেবার শক্তি বিধাতা ওকে দিন, এই আর্শীবাদ ওকে করি।’

‘আর একটু বেদানার রস দাও, আমার গলা শুকিয়ে এসেছে। মণি কি কাল এসেছিল– আমার ঠিক মনে পড়ছে না।’

‘এসেছিল। তখন তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে। শিয়রের কাছে ব’সে অনেকক্ষণ বাতাস ক’রে তার পরে ধোবাকে তোমার কাপড় দিতে গেল।’

‘আশ্চর্য! বোধ হয় আমি ঠিক সেই সময়েই স্বপ্ন দেখছিলুম, যেন মণি আমার ঘরে আসতে চাচ্ছে– দরজা অল্প-একটু ফাঁক হয়েছে– ঠেলাঠেলি করছে কিন্তু কিছুতেই সেইটুকুর বেশি আর খুলছে না। কিন্তূ, মাসি, তোমরা একটু বাড়াবাড়ি করছ– ওকে দেখতে দাও যে আমি মরছি– নইলে মৃত্যুকে হঠাৎ সইতে পারবে না।’

‘বাবা,তোমার পায়ের উপরে এই পশমের শালটা টেনে দিই– পায়ের তেলো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।’

‘না, মাসি, গায়ের উপর কিছু দিতে ভালো লাগছে না ।’

‘জানিস, যতীন? এই শালটা মণির তৈরি, এতদিন রাত জেগে জেগে সে তোমার জন্যে তৈরি করছিল। কাল শেষ করেছে।’

যতীন শালটা লইয়া দুই হাত দিয়ে একটু নাড়াচাড়া করিল । মনে হইল পশমের কোমলতা যেন মণির মনের জিনিস; সে যে যতীনকে মনে করিয়া রাত জাগিয়া এইটি বুনিয়াছে, তাহার মনের সেই প্রেমের ভাবনাটি ইহার সঙ্গে গাঁথা পড়িয়াছে । কেবল পশম দিয়া নহে, মণির কোমল আঙুলের স্পর্শ দিয়া ইহা বোনা । তাই মাসি যখন শালটা তাহার পায়ের উপর টানিয়া দিলেন তখন তাহার মনে হইল,মণিই রাত্রির পর রাত্রি জাগিয়া তাহার পদসেবা করিতেছে ।

‘কিন্তু,মাসি,আমি তো জানতুম,মণি সেলাই করতে পারে না– সে সেলাই করতে ভালোই বাসে না ।’

‘মন দিলে শিখতে কতক্ষণ লাগে । তাকে দেখিয়ে দিতে হয়েছে– ওর মধ্যে অনেক ভুল সেলাইও আছে ।’

‘তা ভুল থাক্‌-না । ও তো প্যারিস এক্‌জিবিশনে পাঠানো হবে না– ভুল সেলাই দিয়ে আমার পা ঢাকা বেশ চলবে ।’

সেলাইয়ে যে অনেক ভুল-ত্রুটি আছে সেই কথা মনে করিয়াই যতীনের আরো বেশি আনন্দ হইল । বেচারা মণি পারে না, জানে না, বার বার ভুল করিতেছে,তবু ধৈর্য ধরিয়া রাত্রির পর রাত্রি সেলাই করিয়া চলিয়াছে– এই কল্পনাটি তাহার কাছে বড়ো করুণ,বড়ো মধুর লাগিল। এই ভুলে-ভরা শালটাকে আবার সে একটু নাড়িয়া-চাড়িয়া লইল ।

‘মাসি,ডাক্তার বুঝি নীচের ঘরে ?’

‘হাঁ,যতীন,আজ রাত্রে থাকবেন ।’

‘কিন্তু আমাকে যেন মিছামিছি ঘুমের ওষুধ দেওয়া না হয় । দেখেছ তো,ওতে আমার ঘুম হয় না , কেবল কষ্ট বাড়ে । আমাকে ভালো ক’রে জেগে থাকতে দাও । জান,মাসি ? বৈশাখ-দ্বাদশীর রাত্রে আমাদের বিয়ে হয়েছিল– কাল সেই দ্বাদশী আসছে– কাল সেইদিনকার রাত্রের সব তারা আকাশে জ্বালানো হবে । মণির বোধ হয় মনে নেই– আমি তাকে সেই কথাটি আজ মনে করিয়ে দিতে চাই ; কেবল তাকে তুমি দু মিনিটের জন্যে ডেকে দাও । চুপ করে রইলে কেন । বোধ হয় ডাক্তার তোমাদের বলেছে,আমার শরীর দুর্বল,এখন যাতে আমার মনে কোনো– কিন্তু,আমি তোমাকে নিশ্চয় বলছি, মাসি, আজ রাত্রে তার সঙ্গে দুটি কথা কয়ে নিতে পারলে আমার মন খুব শান্ত হয়ে যাবে– তা হলে বোধ হয় আর ঘুমোবার ওষুধ দিতে হবে না । আমার মন তাকে কিছু বলতে চাচ্ছে বলেই,এই দু রাত্রি আমার ঘুম হয় নি । মাসি,তুমি অমন করে কেঁদো না। আমি বেশ আছি,আমার মন আজ যেমন ভ’রে উঠেছে,আমার জীবনে এমন আর কখনোই হয় নি । সেইজন্যই আমি মণিকে ডাকছি । মনে হচ্ছে,আজ যেন আমার ভরা হৃদয়টি তার হাতে দিয়ে যেতে পারব । তাকে অনেক দিন অনেক কথা বলতে চেয়েছিলুম, বলতে পারি নি, কিন্তু আর এক মুহূর্ত দেরি করা নয়,তাকে এখনি ডেকে দাও– এর পরে আর সময় পাব না । না,মাসি,তোমার ঐ কান্না আমি সইতে পারি নে । এতদিন তো শান্ত ছিলে, আজ কেন তোমার এমন হল ।’

‘ওরে যতীন, ভেবেছিলুম,আমার সব কান্না ফুরিয়ে গেছে– কিন্তু দেখতে পাচ্ছি, এখনো বাকি আছে, আজ আর পারছি নে ।’

‘মণিকে ডেকে দাও– তাকে ব’লে দেব কালকে রাতের জন্যে যেন– ‘

‘যাচ্ছি,বাবা । শম্ভু দরজার কাছে রইল,যদি কিছু দরকার হয় ওকে ডেকো ।’

মাসি মণির শোবার ঘরে গিয়ে মেজের উপর বসিয়া ডাকিতে লাগিলেন, ‘ওরে,আয়– একবার আয়– আয় রে রাক্ষসী,যে তোকে তার সব দিয়েছে তার শেষ কথাটি রাখ্‌– সে মরতে বসেছে,তাকে আর মারিস নে ।’

0 Shares