যতীন পায়ের শব্দে চমকিয়া উঠিয়া কহিল,’মণি !’
‘না,আমি শম্ভু । আমাকে ডাকছিলেন ?’
‘একবার তোর বউঠাকরুনকে ডেকে দে ।’
‘কাকে?’
‘বউঠাকরুনকে ।’
‘তিনি তো এখনো ফেরেন নি ।’
‘কোথায় গেছেন ?’
‘সীতারামপুরে ।’
‘আজ গেছেন ?’
‘না,আজ তিন দিন হল গেছেন ।’
ক্ষণকালের জন্য যতীনের সর্বাঙ্গ ঝিম্ঝিম্ করিয়া আসিল– সে চোখে অন্ধকার দেখিল । এতক্ষণ বালিশে ঠেসান দিয়া বসিয়াছিল,শুইয়া পড়িল । পায়ের উপর সেই পশমের শাল ঢাকা ছিল,সেটা পা দিয়া ঠেলিয়া দিল।
অনেকক্ষণ পরে মাসি যখন আসিলেন যতীন মণির কথা কিছুই বলিল না । মাসি ভাবিলেন, সে কথা উহার মনে নাই ।
হঠাৎ যতীন এক সময়ে বলিয়া উঠিল,’মাসি,তোমাকে কি আমার সেদিনকার স্বপ্নের কথা বলেছি ।’
‘কোন্ স্বপ্ন ।’
‘মণি যেন আমার ঘরে আসবার জন্য দরজা ঠেলছিল– কোনোমতেই দরজা এতটুকুর বেশি ফাঁক হল না,সে বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল,কিন্তু কিছুতেই ঢুকতে পারল না । মণি চিরকাল আমার ঘরের বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল । তাকে অনেক ক’রে ডাকলুম, কিন্তু এখানে তার জায়গা হল না ।’
মাসি কিছু না বলিয়া চুপ করিয়া রহিলেন । ভাবিলেন,’যতীনের জন্য মিথ্যা দিয়া যে একটুখানি স্বর্গ রচিতেছিলাম সে আর টিঁকিল না । দুঃখ যখন আসে তাহাকে স্বীকার করাই ভালো– প্রবঞ্চনার দ্বারা বিধাতার মার ঠেকাইবার চেষ্টা করা কিছু নয় ।’
‘মাসি,তোমার কাছে যে স্নেহ পেয়েছি সে আমার জন্মজন্মান্তরের পাথেয়,আমার সমস্ত জীবন ভ’রে নিয়ে চললুম । আর-জন্মে তুমি নিশ্চয় আমার মেয়ে হয়ে জন্মাবে, আমি তোমাকে বুকে ক’রে মানুষ করব ।’
‘বলিস কী যতীন,আবার মেয়ে হয়ে জন্মাব ? নাহয়,তোরই কোলে ছেলে হয়েই জন্ম হবে– সেই কামনাই কর-না ।’
‘না,না, ছেলে না । ছেলেবেলায় তুমি যেমন সুন্দরী ছিলে তেমনি অপরূপ সুন্দরী হয়েই তুমি আমার ঘরে আসবে । আমার মনে আছে,আমি তোমাকে কেমন করে সাজাব ।’
‘আর বকিস্ নে,যতীন,বকিসনে– একটু ঘুমো ।’
‘তোমার নাম দেব লক্ষ্মীরানী ।’
‘ও তো একেলে নাম হল না ।’
‘না,একেলে নাম না । মাসি,তুমি আমার সাবেক-কেলে– সেই সাবেক কাল নিয়েই তুমি আমার ঘরে এসো ।’
‘তোর ঘরে আমি কন্যাদায়ের দুঃখ নিয়ে আসবে,এ কামনা আমি তো করতে পারি নে ।’
‘মাসি,তুমি আমাকে দুর্বল মনে কর ?– আমাকে দুঃখ থেকে বাঁচাতে চাও ?’
‘বাছা,আমার যে মেয়েমানুষের মন,আমিই দুর্বল– সেইজন্যেই আমি বড়ো ভয়ে ভয়ে তোকে সকল দুঃখ থেকে চিরদিন বাঁচাতে চেয়েছি । কিন্তু,আমার সাধ্য কী আছে। কিছুই করতে পারি নি ।’
‘মাসি,এ জীবনের শিক্ষা আমি এ জীবনে খাটাবার সময় পেলুম না । কিন্তু ,এ সমস্তই জমা রইল,আসছে বারে মানুষ যে কী পারে তা আমি দেখাব । চিরটা দিন নিজের দিকে তাকিয়ে থাকা যে ফাঁকি,তা আমি বুঝেছি।’
‘যাই বল,বাছা,তুমি নিজে কিছু নাও নি,পরকেই সব দিয়েছ ।’