স্ত্রীর পত্র

ঘৃণায় রাগে আমার সকল শরীর জ্বলতে লাগল। আমি বললুম, ‘এমন ফাঁকির বিয়ে বিয়েই নয়। বিন্দু, তুই যেমন ছিলি তেমনি আমার কাছে থাক্‌, দেখি তোকে কে নিয়ে যেতে পারে।’

তোমরা বললে, ‘বিন্দু মিথ্যা কথা বলছে।’

আমি বললুম , ‘ও কখনো মিথ্যা বলে নি।’

তোমরা বললে, ‘কেমন করে জানলে।’

আমি বললুম,’আমি নিশ্চয় জানি।’

তোমরা ভয় দেখালে, ‘বিন্দুর শ্বশুরবাড়ির লোকে পুলিস-কেস করলে মুশকিলে পড়তে হবে।’

আমি বললুম,’ফাঁকি দিয়ে পাগল বরের সঙ্গে ওর বিয়ে দিয়েছে এ কথা কি আদালত শুনবে না।’

তোমরা বললে,’তবে কি এই নিয়ে আদালত করতে হবে নাকি । কেন, আমাদের দায় কিসের ।’

আমি বললুম, ‘আমি নিজের গয়না বেচে যা করতে পারি করব ।’

তোমরা বললে,’উকিল বাড়ি ছুটবে নাকি ।’

এ কথার জবাব নেই । কপালে করাঘাত করতে পারি, তার বেশি আর কী করব ।

ওদিকে বিন্দুর শ্বশুড়বাড়ি থেকে ওর ভাসুর এসে বাইরে বিষম গোল বাধিয়েছে । সে বলছে, সে থানায় খবর দেবে ।

আমার যে কি জোর আছে জানি নে — কিন্তু কসাইয়ের হাত থেকে যে গরু প্রাণভয়ে পালিয়ে এসে আমার আশ্রয় নিয়েছে তাকে পুলিসের তাড়ায় আবার মন মানতে পারল না । আমি স্পর্ধা করে বললুম,’তারা দিক্‌ থানায় খবর ।’

এই ব’লে মনে করলুম, বিন্দুকে এইবেলা আমার শোবার ঘরে এনে তাকে নিয়ে তালাবদ্ধ করে বসে থাকি । খোঁজ করে দেখি , বিন্দু নেই । তোমাদের সঙ্গে আমার বাদপ্রতিবাদ যখন চলছিল তখন বিন্দু আপনি বাইরে গিয়ে তার ভাসুরের কাছে ধরা দিয়েছে । বুঝেছি, এ বাড়িতে যদি সে থাকে তবে আমাকে সে বিষম বিপদে ফেলবে ।

মাঝখানে পালিয়ে এসে বিন্দু আপন দুঃখ আরও বাড়ালে । তার শাশুড়ির তর্ক এই যে। তার ছেলে তো ওকে খেয়ে ফেলছিল না । মন্দ স্বামীর দৃষ্টান্ত সংসারে দুর্লভ নয়, তাদের সঙ্গে তুলনা করলে তার ছেলে যে সোনার চাঁদ ।

আমার বড়ো জা বললেন, ‘ওর পোড়া কপাল, তা নিয়ে দুঃখ করে কী করব । তা পাগল হোক, ছাগল হোক, স্বামী তো বটে ।’

কুষ্টরোগীকে কোলে করে তার স্ত্রী বেশ্যার বাড়িতে নিজে পৌছে দিয়েছে, সতীসাধ্বীর সেই দৃষ্টান্ত, তোমাদের মনে জাগছিল; জগতের মধ্যে অধমতম কাপুরুষতার এই গল্পটা প্রচার করে আসতে তোমাদের পুরুষের মনে আজ পর্যন্ত একটুও সংকোচবোধ হয় নি, সেইজন্যই মানবজন্ম নিয়েও বিন্দুর ব্যবহারে তোমরা রাগ করতে পেরেছ, তোমাদের মাথা হেঁটে হয় নি । বিন্দুর জন্যে আমার বুক ফেটে গেল কিন্তু তোমাদের জন্যে আমার লজ্জার সীমা ছিল না । আমি তো পাড়াগেঁয়ে মেয়ে,তার উপরে তোমাদের ঘরে পড়েছি, ভগবান কোন্‌ ফাঁক দিয়ে আমার মধ্যে এমন বুদ্ধি দিলেন । তোমাদের এই-সব ধর্মের কথা আমি যে কিছুতেই সইতে পারলুম না ।

আমি নিশ্চয় জানতুম, মরে গেলেও বিন্দু আমাদের ঘরে আর আসবে না, কিন্তু আমি যে তাকে বিয়ের আগের দিন আশা দিয়েছিলুম যে, তাকে শেষ পর্যন্ত ত্যাগ করব না। আমার ছোটো ভাই শরৎ কলকাতায় কলেজে পড়ছিল; তোমরা জানই তো যতরকমের ভলন্টিয়ারি করা,প্লেগের পাড়ার ইঁদুর মারা,দামোদরের বন্যায় ছোটা, এতেই তার এত উৎসাহ যে উপরি উপরি দুবার সে এফ.এ. পরীক্ষায় ফেল করেও কিছুমাত্র দমে যায় নি। তাকে আমি ডেকে বললুম,’বিন্দুর খবর যাতে আমি পাই তোকে সেই বন্দোবস্ত করে দিতে হবে, শরৎ। বিন্দু আমাকে চিঠি লিখতে সাহস করবে না, লিখলেও আমি পাব না।’

এরকম কাজের চেয়ে যদি তাকে বলতুম, বিন্দুকে ডাকাতি করে আনতে কিম্বা তার পাগল স্বামীর মাথা ভেঙে দিতে তা হলে বেশি খুশি হত।

শরতের সঙ্গে আলোচনা করছি এমন সময় তুমি ঘরে এসে বললে, ‘আবার কী হাঙ্গামা বাধিয়েছ।’

আমি বললুম, ‘সেই যা-সব গোড়ায় বাধিয়েছিলুম, তোমাদের ঘরে এসেছিলুম –কিন্তু সে তো তোমাদেরই কীর্তি।’

তুমি জিজ্ঞাসা করলে, ‘বিন্দুকে আবার এনে কোথাও লুকিয়ে রেখেছ?’

আকি বললুম,’বিন্দু যদি আসত তা হলে নিশ্চয় এনে লুকিয়ে রাখতুম। কিন্তু সে আসবে না, তোমাদের ভয় নেই ।’

শরৎকে আমার কাছে দেখে তোমার সন্দেহ আরো বেড়ে উঠল। আমি জানতুম, শরৎ আমাদের বাড়ি যাতায়াত করে, এ তোমরা কিছুতেই পছন্দ করতে না। তোমাদের ভয় ছিল, ওর ‘পরে পুলিসের দৃষ্টি আছে — কোন্‌ দিন ও কোন্‌ রাজনৈতিক মামলায় পড়বে, তখন তোমাদের সুদ্ধ জড়িয়ে ফেলবে। সেইজন্যে আমি ওকে ভাইফোঁটা পর্যন্ত লোক দিয়ে পাঠিয়ে দিতুম, ঘরে ডাকতুম না।

তোমার কাছে শুনলুম, বিন্দু আবার পালিয়েছে, তাই তোমাদের বাড়িতে তার ভাসুর খোঁজ করতে এসেছে। শুনে আমার বুকের মধ্যে শেল বিঁধল। হতভাগিনীর যে কী অসহ্য কষ্ট তা বুঝলুম অথচ কিছুই করবার রাস্তা নেই ।

শরৎ খবর নিতে ছুটল। সন্ধ্যার সময় ফিরে এসে আমাকে বললে, বিন্দু তার খুড়তুতো ভাইদের বাড়ি গিয়েছিল, কিন্তু তারা তুমুল রাগ করে তখনই আবার তাকে শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছে। এর জন্যে তাদের খেসারত এবং গাড়িভাড়া দন্ড যা ঘটেছে, তার ঝাঁজ এখনো তাদের মন থেকে মরে নি।

তোমাদের খুড়িমা শ্রীক্ষেত্রে তীর্থ করতে যাবেন বলে তোমাদের বাড়িতে এসে উঠেছেন। আমি তোমাদের বললুম, ‘আমিও যাব।’

আমার হঠাৎ এমন ধর্মে মন হয়েছে দেখে তোমরা এত খুশি হয়ে উঠলে যে, কিছুমাত্র আপত্তি করলে না। এ কথাও মনে ছিল যে,এখন যদি কলকাতায় থাকি তবে আবার কোন্‌ দিন বিন্দুকে নিয়ে ফ্যাসাদ বাধিয়ে বসব। আমাকে নিয়ে বিষম ল্যাঠা।

0 Shares