বীরেনবাবু বলিলেন, ‘বেশ বেশ। আচ্ছা, উপস্থিত কোন পথে চললে ভাল হয়, কিছু ইঙ্গিত দিতে পারেন কি? যা হোক একটা সূত্র ধরে কাজ আরম্ভ করতে হবে তো।’
ব্যোমকেশ, ঈষৎ চিন্তা করিয়া বলিল, ‘ডাক্তার রুদ্র’র দিক থেকে কাজ আরম্ভ করুন; এ গোলক-ধাঁধার সত্যিকার পথ হয়তো ঐ দিকেই আছে।’
বীরেনবাবু চকিতভাবে চাহিলেন, ‘ও-আচ্ছা—’
তিনি নতমস্তকে ভাবিতে ভাবিতে প্ৰস্থান করিলেন।
৬
ইহার পর পাঁচ ছয় দিন একটানা ঘটনাহীনভাবে কাটিয়া গেল। ব্যোমকেশ আবার যেন বিমাইয়া পড়িল। সকালে কাগজ পড়া এবং বৈকালে টেবিলের উপর পা তুলিয়া দৃষ্টিহীন চক্ষু শূন্যে মেলিয়া থাকা ছাড়া তাহার আর কাজ রহিল না।
বীরেনবাবুও এ কয়দিনের মধ্যে দেখা দিলেন না, তাই তাঁহার তদন্ত কতদূর অগ্রসর হইল, জানিতে পারিলাম না। আগন্তুকের মধ্যে কেবল হাবুল একবার করিয়া আসিত। সে আসিলে ব্যোমকেশ নিজের অবসাদ ঝাড়িয়া ফেলিয়া নানাবিধ আলোচনায় তাহাকে প্রফুল্ল করিবার চেষ্টা করিত। কিন্তু হাবুলের মনে যেন একটা বিমর্ষ অবসন্নতা স্থায়ীভাবে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিল। সে নৈরাশ্যপূর্ণ দীপ্তিহীন চোখে চাহিয়া নীরবে বসিয়া থাকিত, তারপর আস্তে আস্তে উঠিয়া চলিয়া যাইত।
বাড়িতে কি হইতেছে না হইতেছে, জিজ্ঞাসা করিলেও সে ভালরূপ জবাব দিতে পারিত না। বিমাতার রসনা নরম না হইয়া আরও তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিয়াছে, তাহার কথার ভঙ্গীতে ইহার আভাস পাইতাম। শেষদিন সে নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘বাবা আজ রাত্রে পাটনা যাচ্ছেন; সেখানে য়ুনিভার্সিটিতে লেকচার দিতে হবে।’ বুঝিলাম, শোকের উপর অহৰ্নিশি কথার কচকচি সহ্য করিতে না পারিয়া তিনি পলায়ন করিতেছেন। এই নিলিপ্তিস্বভাব বৈজ্ঞানিকের পারিবারিক অশান্তির কথা ভাবিয়া দুঃখ হইল।
সেদিন হাবুল প্ৰস্থান করিবার পর বীরেনবাবু আসিলেন। তাঁহার মুখ দেখিয়া বুঝিলাম, বিশেষ সুবিধা করিতে পারেন নাই। যা হোক, ব্যোমকেশ তাঁহাকে সমাদর করিয়া বসাইল।
আমাদের বৈকালিক চায়ের সময় হইয়াছিল, অচিরাৎ চা আসিয়া পৌঁছিল। তখন ব্যোমকেশ বীরেনবাবুকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘তারপর-খবর কিছু আছে?’
পেয়ালায় চুমুক দিয়া বিমৰ্ষভাবে বীরেনবাবু বলিলেন, ‘কোনও দিকেই কিছু সুবিধা হচ্ছে না। যেদিকে হাত বাড়াচ্ছি কিছু ধরতে ছুঁতে পারছি না, প্রমাণ পাওয়া তো দূরের কথা, একটা সন্দেহের ইশারা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ, আমার দৃঢ় ধারণা জন্মেছে যে, এর ভেতর একটা গভীর রহস্য লুকোনো রয়েছে; যতই প্রতিপদে ব্যর্থ হচ্ছি, ততই এ বিশ্বাস দৃঢ় হচ্ছে।’
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘মৃত্যুর কারণ সম্বন্ধে নূতন কিছু জানতে পেরেছেন?’
বীরেনবাবু বলিলেন, ‘আমি ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছিলুম। তিনি অবশ্য রিপোর্টের বাইরে যেতে রাজী নন, তবু মনে হল, তাঁর একটা থিয়োরি আছে। তিনি মনে করেন, কোনও অজ্ঞাত বিষের বাষ্প নাকে যাওয়ার ফলেই মৃত্যু হয়েছে। তিনি খুব অস্পষ্ট আবছায়াভাবে কথাটা বললেন বটে, তবু মনে হল, তাঁর ঐ বিশ্বাস।’
ব্যোমকেশ একটু ভাবিয়া বলিল, “উনুন ধরাবার সময় মৃত্যু হয়েছিল, এ কথা ডাক্তারকে বলেছিলেন বুঝি?’
‘হ্যাঁ।’
আরও কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘যাক। আর এ দিকে? ডাক্তার রুদ্র সম্বন্ধে খোঁজ নিয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ। যতদূর জানতে পারলুম, লোকটা নির্জলা পাষণ্ড আর অর্থাপিশাচ। কয়েকজন ধনুষ্টঙ্কারের রোগীর উপর নিজের আবিষ্কৃত ইনজেকশান পরীক্ষা করতে গিয়ে তাদের সাবাড় করেছে, এ গুজবও শুনেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বর্তমান ব্যাপারে তাকে খুনের আসামী করা যায় না। দেবকুমারবাবুর মেয়ের সঙ্গে ওর ছেলের সম্বন্ধ হয়েছিল, এ খবরও ঠিক। লোকটা দশ হাজার টাকা বরপণ দাবি করেছিল। দেবকুমারবাবুর অত টাকা দেবার ক্ষমতা নেই, কাজেই তাঁকে সম্বন্ধ ভেঙে দিতে হল। ডাক্তার রুদ্র’র ছেলেটা কিন্তু ভদ্রলোক। বাপের সঙ্গে এই নিয়ে তার ভীষণ ঝগড়া বেধে গিয়েছিল। ইতিমধ্যে এ বাড়িতে এই কাণ্ড–মেয়েটি হঠাৎ মারা গেল। তারপর ছোকরাটি শুনলুম বাড়ি ছেড়ে কোথায় চলে গেছে; তার বিশ্বাস, তার বাপাই প্ৰকারান্তরে মেয়েটির মৃত্যুর কারণ।’
মন্মথ যে পিতৃগৃহ ত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে, এ সংবাদ নূতন বটে, কিন্তু আর সব কথাই আমরা পূর্ব হইতে জনিতাম। তাই পুরাতন কথা শুনিতে শুনিতে ব্যোমকেশ একটু অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়ছিল। বীরেনবাবু থামিলে সে প্রশ্ন করিল, ‘দেবকুমারবাবুর আর্থিক অবস্থা সম্বন্ধে অনুসন্ধান করবেন বলেছিলেন, করেছিলেন না কি?’
‘করেছিলুম। তাঁর আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। ধারকার্জ নেই বটে, কিন্তু মেয়ের বিয়েতে দশ-বারো হাজার টাকা খরচ করা তাঁর অসাধ্য। লোকটি বোধ হয় বেহিসাবী, সাংসারিক বুদ্ধি কম। কলেজ থেকে বর্তমানে তিনি আটশ’ টাকা মাইনে পান। কিন্তু শুনলে আশ্চর্য হবেন, এই আটশ’ টাকার অধিকাংশই যায় তার বীমা কোম্পানির পেটে। পঞ্চাশ হাজার টাকার লাইফ ইন্সিওরেন্স করিয়েছেন, তাও এত বেশি বয়সে যে প্রিমিয়াম দিয়ে হাতে বড় কিছু থাকে না।’
ব্যোমকেশ বিস্মিতভাবে বলিল, ‘পঞ্চাশ হাজার টাকার লাইফ ইন্সিওরেন্স! নিজের নামে করেছেন?’
‘শুধু নিজের নামে নয়—জয়েন্ট পলিসি, নিজের আর স্ত্রী নামে। মাত্র এক বছর হল পলিসি নিয়েছেন। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী–তিনি মারা গেলে পাছে বিধবাকে পথে দাঁড়াতে হয়, এই জন্যেই বোধ হয়। দুজনে একসঙ্গে বীমা করিয়েছেন। এ টাকায় উত্তরাধিকারীদের দাবি থাকবে না।’