৭
পুলিস আসিয়া পৌঁছতে বিলম্ব হইল না। আমরা দেবকুমারবাবুর ঠিকানা পুলিসকে জানাইয়া বাহির হইয়া আসিলাম।
তখন রাস্তায় গ্যাস জ্বলিয়াছে। দ্রুতপদে বাসার দিকে ফিরিতে ফিরিতে ব্যোমকেশ কয়েকবার যেন ভয়ার্ত শ্বাস-সংহত স্বরে বলিল, ‘উঃ! নিয়তির কি নির্মম প্ৰতিশোধ! কি নিদারুণ পরিহাস!’
আমার মাথার ভিতর বুদ্ধিবৃত্তি যেন স্তম্ভিত নিশ্চল হইয়া গিয়াছিল; তবু অসীম অনুশোচনার সঙ্গে কেবল এই কথাটাই মনে হইতে লাগিল–পরলোক যদি থাকে, তবে যাহার মৃত্যুতে হাবুল এত কাতর হইয়াছিল সেই পরম স্নেহাস্পদ ভগিনীর সহিত তাহার এতক্ষণে মিলন হইয়াছে।
বাসায় পৌঁছিয়া ব্যোমকেশ নিজের লাইব্রেরি-ঘরে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিল। শুনিতে পাইলাম, সে টেলিফোনে কথা বলিতেছে।
প্রায় এক ঘণ্টা পরে সে ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিয়া ক্লান্তস্বরে পুটরামকে চা তৈয়ার করিতে বলিল, তারপর বুকে ঘাড় গুজিয়া একখানা চেয়ারে বসিয়া পড়িল। যে ট্র্যাজেডির শেষ অঙ্কে যবনিকা পড়িতে আর দেরি নাই, তাহার সম্বন্ধে বৃথা প্রশ্ন করিয়া আমি আর তাহাকে বিরক্ত করিলাম না।
রাত্রি সাড়ে আটটার সময় বীরেনবাবু আসিলেন। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘ওয়ারেন্ট এনেছেন?’
বীরেনবাবু ঘাড় নাড়িলেন।
তখন আবার আমরা বাহির হইলাম।
দেবকুমারবাবুর বাসায় আসিতে তিন চার মিনিট লাগিল। দেখিলাম, বাড়ি নিস্তব্ধ, উপরের ঘরগুলির জানালায় আলো নাই, কেবল নীচে বসিবার ঘরে বাতি জ্বলিতেছে।
বীরেনবাবু কড়া নাড়িলেন, কিন্তু ভিতর হইতে সাড়া আসিল না। তখন তিনি দ্বার ঠেলিলেন, ভেজানো দ্বার খুলিয়া গেল। আমরা ভিতরে প্রবেশ করিলাম।
বাহিরের ক্ষুদ্র ঘরটিতে তক্তপোশ পাতা, তাহার উপর দেবকুমারবাবু নিশ্চলভাবে বসিয়া আছেন। আমরা প্রবেশ করিলে তিনি রক্তবর্ণ চক্ষু তুলিয়া আমাদের পানে চাহিলেন। কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিবার পর তাঁহার মুখে একটা তিক্ত হাসি দেখা দিল, তিনি মাথা নাড়িয়া অস্ফুট স্বরে বলিলেন, ‘সকলি গরল ভেল–’
বীরেনবাবু অগ্রসর হইয়া বলিলেন, ‘দেবকুমারবাবু্, আপনার নামে ওয়ারেন্ট আছে।’
দেবকুমারবাবুর যেন চমক ভাঙ্গিল, তিনি দারোগাবাবুর পরিচ্ছদের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন, ‘আপনারা এসেছেন-ভালই হল। আমি নিজেই থানায় যাচ্ছিলুম—’ দুই হাত বাড়াইয়া দিয়া বলিলেন, ‘হাতকড়া লাগান।’
বীরেনবাবু বলিলেন, ‘তার দরকার নেই। কোন অপরাধে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হল শুনুন— বলিয়া অভিযোগ পড়িয়া শুনাইবার উপক্ৰম করিলেন।
দেবকুমারবাবু কিন্তু ইতিমধ্যে আবার অন্যমনস্ক হইয়া পড়িলেন; পকেটে হাত দিয়া তিনি যেন কি খুঁজতে খুঁজতে নিজ মনে বলিলেন, ‘নিয়তি! নইলে হাবুলও ঐ বাক্স থেকেই দেশলায়ের কাঠি বার করতে গেল কেন? কি ভেবেছিলুম, কি হল! ভেবেছিলুম, রেখার ভাল বিয়ে দেব, নিজের একটা বড় ল্যাবরেটরি করব, হাবুলকে বিলেত পাঠাব–’ পকেট হইতে সিগার বাহির করিয়া তিনি মুখে ধরিলেন।
ব্যোমকেশ নিজের দেশলাই জ্বালিয়া তাঁহার সিগারে অগ্নি সংযোগ করিয়া দিল। তারপর বলিল, ‘দেবকুমারবাবু্, আপনার দেশলাইটা আমাদের দিতে হবে।’
দেবকুমারবাবুর চোখে আবার সচেতন দৃষ্টি ফিরিয়া আসিল, তিনি বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু? আপনিও এসেছেন? ভয় নেই–আমি আত্মহত্যা করব না। ছেলেকে মেরেছি–মেয়েকে মেরেছি, আমি খুনী আসামীর মত ফাঁসিকাঠে ঝুলতে চাই–’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘দেশলাইয়ের বাক্সট তবে দিন।’
সাবধান, বড় ভয়ানক জিনিস। প্রত্যেকটি কাঠি এক-একটি মৃত্যুবাণ। একবার জ্বলিলে আর রক্ষে নেই—‘ বোমকেশ দেশলাইয়ের বাক্সটা বীরেনবাবুর হাতে দিল, তিনি সন্তৰ্পণে সেটা পকেটে রাখিলেন। দেবকুমারবাবু বলিয়া চলিলেন, ‘কি অদ্ভুত আবিষ্কারই করেছিলুম; পলকের মধ্যে মৃত্যু হবে, কিন্তু কোথাও এতটুকু চিহ্ন থাকবে না। আধুনিক যুদ্ধ-নীতির আমূল পরিবর্তন হয়ে যেত! বিষ নয়–এ মহামারী। কিন্তু সকলি গরল ভেল—’ তিনি বুকভাঙা গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিলেন।
বীরেনবাবু মৃদুস্বরে বলিলেন, ‘দেবকুমারবাবু্, এবার যাবার সময় হয়েছে।’
‘চলুন’–তিনি তৎক্ষণাৎ উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
ব্যোমকেশ একটু কুষ্ঠিত স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনার স্ত্রী কি বাড়িতেই আছেন?’
‘স্ত্রী!’–দেবকুমারবাবুর চোখ পাগলের চোখের মত ঘোলা হইয়া গেল। তিনি হা হা করিয়া অট্টহাস্য করিয়া উঠিলেন, বলিলেন, ‘স্ত্রী! আমার ফাঁসির পর ইন্সিওরেন্সের সব টাকা সেই পাবে! প্রকৃতির পরিহাস নয়? চলুন।’
একটা ট্যাক্সি ডাকা হইল। ব্যোমকেশ হাত ধরিয়া দেবকুমারবাবুকে তাহাতে তুলিয়া দিল; বীরেনবাবু তাঁহার পাশে বসিলেন। দুইজন কনস্টেবল ইতিমধ্যে কোথা হইতে আবির্ভূত হইয়াছিল, তাহারাও ট্যাক্সিতে চাপিয়া বসিল।
দেবকুমারবাবু গাড়ির ভিতর হইতে বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু্, আপনি আমার রেখার মৃত্যুর কিনারা করতে চেয়েছিলেন–আপনাকে ধন্যবাদ—’
আমরা ফুটপাথে দাঁড়াইয়া রহিলাম, ট্যাক্সি চলিয়া গেল।
দিন দুই বোমকেশ এ বিষয়ে কোনও কথা কহিল না। তাহার মনের অবস্থা বুঝিয়া আমিও পীড়াপীড়ি করিলাম না।
তৃতীয় দিন বৈকালে সে নিজেই বলিতে আরম্ভ করিল; এলোমেলোভাবে কতকটা যেন নিজ মনেই বলিতে লাগিল–