‘ইংরেজিতে একটা কথা আছে–vengeance coming home to roost, দেবকুমারবাবুর হয়েছিল তাই! নিজের স্ত্রীকে তিনি মারতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এমনই অদৃষ্ট্রের খেলা, দু’বার তিনি তাঁর অমোঘ অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করলেন, দু’বারই সে অগ্নিবাণ লাগল গিয়ে তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় পুত্ৰ-কন্যার বুকে।
‘দেবকুমার অপ্রত্যাশিতভাবে এক আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। কিন্তু টাকার অভাবে সে আবিষ্কারের সদ্ব্যবহার করতে পারছিলেন না। এ এমনই আবিষ্কার যে, তার পেটেন্ট নেওয়া চলে না; কারণ, সাধারণ ব্যবসায়-জগতে এর ব্যবহার নেই। কিন্তু ঘৃণাক্ষরে এর ফরমুলা জানতে পারলে জাপান জামানী ফ্রান্স প্রভৃতি যুদ্ধোদ্যত রাজ্যলোলুপ জাতি নিজেদের কারখানায় এই প্রাণঘাতী বিষ তৈরি করতে আরম্ভ করে দেবে। আবিষ্কর্তা কিছুই করতে পারবেন না, এতবড় আবিষ্কার থেকে তাঁর এক কপর্দক লাভ হবে না।
‘সুতরাং আবিষ্কারের কথা দেবকুমারবাবু চেপে গেলেন। প্রথমে টাকা চাই, কারণ এ বিষ কি করে ব্যবহার করা যেতে পারে, সে বিষয়ে আরও অনেক এক্সপেরিমেন্ট করা দরকার। কিন্তু টাকা কোথায়? এত বড় এক্সপেরিমেন্ট গোপনে চালাতে গেলে নিজের ল্যাবরেটরি চাই–তাতে অনেক টাকার দরকার। কিন্তু টাকা আসে কোথা থেকে?
‘এ দিকে বাড়িতে দেবকুমারবাবুর স্ত্রী তাঁর জীবন দুর্বাহ করে তুলেছিলেন। মানসিক পরিশ্রম যারা করে, তারা চায় সাংসারিক ব্যাপারে শান্তি, অথচ তাঁর জীবনে ঐ জিনিসটির একান্ত অভাব হয়ে উঠেছিল। এক শুচিবায়ুগ্ৰস্ত মুখরা স্নেহহীনা স্ত্রীর নিত্য সাহচর্য তাঁকে পাগলের মত করে তুলেছিল। এটা অনুমানে বুঝতে পারি; দেবকুমারবাবু স্বভাবত নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক নন, শান্তিতে নিজের বৈজ্ঞানিক চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকতে পারলে তিনি আর কিছু চান না। তাঁর মনটি যে খুব স্নেহপ্রবণ, তাঁর ছেলেমেয়েদের প্রতি ভালবাসা দেখেই আন্দাজ করা যায়। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীও চেষ্টা করলে এই স্নেহের অংশ পেতে পারতেন; কিন্তু স্বভাবদোষে তিনি তা পেলেন। না; বরঞ্চ দেবকুমারবাবু তাঁকে বিষবৎ ঘৃণা করতে আরম্ভ করলেন।
‘নিজের স্ত্রীকে হত্যা করবার ইচ্ছা মানুষের স্বাভাবিক নয়; যখন এ প্রবৃত্তি তার হয় তখন বুঝতে হবে–সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে। দেবকুমারবাবুরাও সহ্যের সীমা অতিক্রান্ত হয়েছিল। তারপর তিনি যখন এই ভয়ঙ্কর বিষ আবিষ্কার করলেন, তখন বোধ হয়, প্রথমেই তাঁর মনে হল স্ত্রীর কথা। তিনি মনে মনে আগুন নিয়ে খেলা আরম্ভ করলেন।
‘তারপর তাঁর সংশয়ের সমাধান করে বীমা কোম্পানির যুগ্মজীবন পলিসির বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল-স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে বীমা করতে পারে, একজন মরলে অন্য জন টাকা পাবে। এমন সুযোগ তিনি আর কোথায় পাবেন? যদি এইভাবে জীবনবীমা করে তাঁর আবিষ্কৃত বিষ দিয়ে স্ত্রীকে মারতে পারেন—এক টিলে দুই পাখি মরবে; তিনি তাঁর বাঞ্ছিত টাকা পাবেন, স্ত্রীও মরবে এমনভাবে যে কেউ বুঝতে পারবে না, কি করে মৃত্যু হল।
‘দেবকুমারবাবু একেবারে পঞ্চাশ হাজার টাকার জীবনবীমা করলেন, তারপর অসীম ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করতে লাগলেন। তাড়াতাড়ি করলে চলবে না, বীমা কোম্পানির সন্দেহ হতে পারে। এইভাবে এক বছর কেটে গেল। তিনি মনে মনে স্থির করলেন, এই বড়দিনের ছুটিতে তাঁর মৃত্যুবাণ নিক্ষেপ করবেন।
‘তাঁর আবিষ্কৃত বিষের প্রকৃতি অনেকটা বিস্ফোরক বারুদের মত; এমনিতে সে অতি নিরীহ, কিন্তু একবার আগুনের সংস্পর্শে এলে তার ভয়ঙ্কর শক্তি বাম্পরূপ ধরে বেরিয়ে আসে। সে-বাস্প কারুর নাকে কণামাত্র গেলেও আর রক্ষে নেই, তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হবে।
‘দেবকুমারবাবু তাঁর স্ত্রীর উপর এই বিষ প্রয়োগ করবার এক চমৎকার উপায় বার করলেন। বৈজ্ঞানিক মাথা ছাড়া এমন বুদ্ধি বেরোয় না। তিনি কতকগুলি দেশলাইয়ের কাঠির বারুদের সঙ্গে এই বিষ মাখিয়ে দিলেন। কি উপায়ে মাখালেন, বলতে পারি না, কিন্তু ফল দাঁড়ালো—যিনি সেই কাঠি জ্বালবেন, তাঁকেই মরতে হবে। এইভাবে বিষাক্ত দেশলাইয়ের কাঠি তৈরি করে তিনি দিল্লীতে বিজ্ঞান-সভার অধিবেশনে যোগ দেবার জন্যে প্ৰস্তুত হতে লাগলেন। ক্রমে দিল্লীতে যাবার সময় উপস্থিত হল; তখন তিনি সময় বুঝে তাঁর স্ত্রীর দেশলাইয়ের বাক্সতে একটি কাঠি রেখে দিয়ে দিল্লীতে যাত্রা করলেন। তিনি জানতেন, তাঁর স্ত্রী রোজ রাত্ৰিতে শোবার আগে ঐ দেশলাই দিয়ে ল্যাম্প জ্বলেন-এ দেশলাইয়ের বাক্স অন্যত্র ব্যবহার হয় না। আজ হোক, কাল হোক, গৃহিণী সেই কাঠিটি জ্বালাবেন। দেবকুমারবাবু থাকবেন তখন ন’শ মাইল দূরে—এ যে তাঁর কাজ, এ কথা কেউ মনেও আনতে পারবে না।
‘সবই ঠিক হয়েছিল, কিন্তু রাম উল্টো বুঝলেন। স্ত্রীর বদলে রেখা উনুন ধরাতে গিয়ে সেই কাঠিটি জ্বালালে।
‘দিল্লী থেকে দেবকুমারবাবু ফিরে এলেন। এই বিপর্যয়ে তাঁর মন স্ত্রীর বিরুদ্ধে আরও বিষিয়ে উঠল। তাঁর জিদ চড়ে গেল, মেয়ে যখন গিয়েছে, তখন ওকেও তিনি শেষ করে ছাড়বেন। কয়েকদিন কেটে গেল, তারপর আবার তিনি স্ত্রীর দেশলাইয়ের বাক্সে একটি কাঠি রেখে পাটনা যাবার জন্য তৈরি হলেন।
‘কিন্তু এবার আর তাঁকে যেতে হল না। হাবুল সিগারেট খেত; বোধহয়, তার দেশলাইয়ের বাক্সটা খালি হয়ে গিয়েছিল, তাই সে সৎমার ঘরের দেশলাইয়ের বাক্স থেকে কয়েকটি কাঠি নিজের বাক্সে পুরে নিয়ে বেড়াতে চলে গেল। তারপর–
‘কি ভয়ঙ্কর সর্বনাশী কালকূট যে দেবকুমারবাবু বিজ্ঞানসাগর মন্থন করে তুলেছিলেন তাঁর জীবনে—সকলি গরিল ভেল।’