অগ্নিবাণ

ব্যোমকেশ একটা নিশ্বাস ফেলিয়া চুপ করিল। কিয়ৎকাল পরে আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘আচ্ছা‌, দেবকুমারবাবু যে অপরাধী‌, এটা তুমি প্রথম বুঝলে কখন?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘যে মুহুর্তে শুনলুম যে‌, দেবকুমারবাবু পঞ্চাশ হাজার টাকার জীবনবীমা করিয়েছেন‌, সেই মুহুর্তে। তার আগে রেখাকে হত্যা করবার একটা সন্তোষজনক উদ্দেশ্যই পাওয়া যাচ্ছিল না। কে তাকে মেরে লাভবান হল‌, কার স্বার্থে সে ব্যাঘাত দিচ্ছিল-এ কথাটার ভাল রকম জবাব পাওয়া যাচ্ছিল না। রেখা যে হত্যাকারীর লক্ষ্য নয়‌, তা তো আমরা জানতুম না।

‘কিন্তু আর একদিক থেকে একটি ছোট্ট সূত্ৰ হাতে এসেছিল। রেখার দেহ-পরীক্ষায় যখন বিষ পাওয়া গেল না‌, তখন কেবল একটা সম্ভাবনাই গ্রহণযোগ্য রইল—অর্থাৎ যে-বিষে তার মৃত্যু হয়েছে‌, সে-বিষ বৈজ্ঞানিকদের অপরিচিত। মানে‌, নূতন আবিষ্কার। মনে আছে—দিল্লীতে দেবকুমারবাবুর বক্তৃতা? আমরা তখন সেটা অক্ষমের বাহ্বাস্ফোট বলে উড়িয়ে দিয়েছিলুম। কে জানত‌, তিনি সত্যই এক অদ্ভুত আবিষ্কার করে বসে আছেন; আর‌, তারই চাপা ইঙ্গিত তাঁর বক্তৃতায় ফুটে বেরুচ্ছে!

‘সে যাক হোক‌, কথা দাঁড়ালো—এই নূতন আবিষ্কার কোথা থেকে এল? দুজন বৈজ্ঞানিক হাতের কাছে রয়েছে–এক‌, ডাক্তার রুদ্র‌, দ্বিতীয় দেবকুমারবাবু। এঁদের দুজনের মধ্যে একজন এই অজ্ঞাত বিষের আবিষ্কর্তা। কিন্তু ডাক্তার রুদ্রর উপর সন্দেহটা বেশি হয়‌, কারণ তিনি ডাক্তার‌, বিষ নিয়ে নাড়াচাড়া তাঁরই বেশি। তা ছাড়া দেবকুমারবাবু বিষের আবিষ্কর্তা হলে তিনি কি নিজের মেয়ের উপর সে বিষ প্রয়োগ করবেন?

‘কাজেই সব সন্দেহ পড়ল গিয়ে ডাক্তার রুদ্র’র উপর। কিন্তু তবু আমার মন খুঁতখুঁত করতে লাগল। ডাক্তার রুদ্র লোকটা অতি পাজি‌, কিন্তু তাই বলে সে এত সামান্য কারণে একটি মেয়েকে খুন করবে? আর‌, যদিই বা সে তা করতে চায়‌, রেখার নাগাল পাবে কি করে? কোন উপায়ে আর একজনের বাড়িতে বিষ পাঠাবে? রেখার সঙ্গে মন্মথর ছাদের উপর থেকে দেখাদেখি চিঠি-ফেলাফেলি। চলত; কিন্তু রুদ্রর সঙ্গে তো সে রকম কিছু ছিল না।

‘কোনও বিষাক্ত বাস্পই যে মৃত্যুর কারণ‌, এ চিন্তাটা গোড়া থেকে আমার মাথায় ধোঁয়ার মত ঘুরে বেড়াচ্ছিল। মনে করে দেখ‌, রেখার এক হাতে পোড়া দেশলাইয়ের কাঠি্‌্‌, আর এক হাতে বাক্স ছিল; অর্থাৎ দেশলাই জ্বালার পরই মৃত্যু হয়েছে। সংযোগটা সম্পূর্ণ আকস্মিক হতে পারে‌, আবার কার্য কারণ সম্বন্ধও থাকতে পারে। দেবকুমারবাবু্‌, কিন্তু বড় চালাকি করেছিলেন‌, বাক্সে একটি বৈ বিষাক্ত কাঠি দেননি–যাতে বাক্সের অন্যান্য কাঠি পরীক্ষা করে কোনও হদিস পাওয়া না যায়। আমি সে বাক্সটা এনেছিলুম‌, পরীক্ষাও করেছিলুম‌, কিন্তু কিছু পাইনি। হাবুলের বেলাতেও বাক্সে একটি বিষাক্ত কঠিই ছিল‌, কিন্তু এমনই দুৰ্দৈব যে‌, সেইটেই হাবুল পকেটে করে নিয়ে এল–আর প্রথমেই জ্বালালে।

‘অজিত‌, তুমি তো লেখক‌, দেবকুমারবাবুর এই ব্যাপারের মধ্যে একটা প্ৰকাণ্ড রূপক দেখতে পাচ্ছ না? মানুষ যেদিন প্ৰথম অন্যকে হত্যা করবার অস্ত্র আবিষ্কার করেছিল‌, সেদিন সে নিজেরই মৃত্যুবাণ নির্মাণ করেছিল; আর আজ সারা পৃথিবী জুড়ে গোপনে গোপনে এই যে হিংসার কুটিল বিষ তৈরি হচ্ছে‌, এও মানুষ জাতটাকে একদিন নিঃশেষে ধ্বংস করে ফেলবে–ব্ৰহ্মার ধ্যান-উদ্ভূত দৈত্যের মত সে স্ৰষ্টাকেও রেয়াৎ করবে না। মনে হয় না কি?’

ঘর অন্ধকার হইয়া গিয়াছিল‌, ব্যোমকেশকে ভাল দেখা যাইতেছিল না। আমার মনে হইল‌, তাহার শেষ কথাগুলো কেবল জল্পনা নয়–ভবিষ্যদবাণী।

(সমাপ্ত)

0 Shares