অগ্নিবাণ

এই হাবুলের পিতা কিরূপ বক্তৃতা দিয়াছেন‌, জানিবার জন্য একটু কৌতুহল হইল। পড়িয়া দেখিলাম‌, দেশী বৈজ্ঞানিকদের অভাব অসুবিধার সম্বন্ধে ভদ্রলোক যাহা বলিয়াছেন‌, তাহা নেহাত মিথ্যা নয়। ব্যোমকেশকে পড়িয়া শুনাইলে তাহার মনটা বিষয়াস্তরে সঞ্চারিত হইয়া হয়তো একটু প্ৰফুল্ল হইতে পারে‌, তাই বলিলাম‌, ‘ওহে‌, হাবুলের বাবা দেবকুমারবাবু বক্তৃতা দিয়েছেন‌, শোনো।‘

ব্যোমকেশ কড়িকাঠ হইতে চক্ষু নামাইল না‌, বিশেষ ঔৎসুক্যও প্রকাশ করিল না। আমি্‌্‌, পড়িতে আরম্ভ করিলাম–

‘এ কথা সত্য যে‌, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাহায্য ব্যতীত কোনও জাতি বড় হইতে পারে নাই। অনেকের ধারণা এইরূপ যে‌, ভারতবাসী বৈজ্ঞানিক গবেষণায় পরাভূখ এবং তাহাদের উদ্ভাবনী শক্তি নাই—এই জন্যই ভারত পরনির্ভর ও পরাধীন হইয়া আছে। এই ধারণা যে সম্পূর্ণ ভ্ৰমাত্মক‌, ভারতের গরিমাময় অতীত তাহার প্রমাণ। নব্য-বিজ্ঞানের যাহা বীজমন্ত্র, তাহা যে ভারতেই প্রথম আবিষ্কৃত হইয়াছিল ও পরে কাশপুষ্পের বীজের ন্যায় বায়ুতাড়িত হইয়া দূর-দূরান্তরে ছড়াইয়া পড়িয়াছে‌, তাহা সুধীসমাজে উল্লেখ করা বাহুল্যমাত্র। গণিত‌, জ্যোতিষ‌, নিদান‌, স্থাপত্য-এই চতুস্তম্ভের উপর আধুনিক বিজ্ঞান ও তৎপ্রসূত সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত‌, অথচ ঐ চারিটি বিজ্ঞানেরই জন্মভূমি ভারতবর্ষ।

‘কিন্তু এ কথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে‌, বর্তমানে আমাদের এই অসামান্য উদ্ভাবনী প্রতিভা নিস্তেজ ও ম্ৰিয়মাণ হইয়া পড়িয়াছে। ইহার কারণ কি? আমরা কি মানসিক বলে পূর্বাপেক্ষা হীন হইয়া পড়িয়াছি? না–তাহা নহে। আমাদের প্রতিভা অ-ফলপ্রসূ হইবার অন্য কারণ আছে।

‘পুরাকালে আচার্য ও ঋষিগণ-যাঁহাদের বর্তমানকালে আমরা savant বলিয়া থাকি–রাজ-অনুগ্রহের আওতায় বসিয়া সাধনা করিতেন। অর্থচিন্তা তাঁহাদের ছিল না‌, অর্থের প্রয়োজন হইলে রাজা সে অর্থ যোগাইতেন; সাধনার সাফল্যের জন্য যাহা কিছু প্রয়োজন হইত‌, রাজকোষের অসীম ঐশ্বর্য তৎক্ষণাৎ তাহা যোগাইয়া দিত। আচার্যগণ অভাবমুক্ত হইয়া কুষ্ঠাহীন-চিত্তে সাধনা করিতেন এবং অস্তিমে সিদ্ধি লাভ করিতেন।

‘কিন্তু বর্তমান ভারতীয় বৈজ্ঞানিকের অবস্থা কিরূপ? রাজা বৈজ্ঞানিক-গবেষণার পরিপোষক নহেন-ধনী ব্যক্তিরাও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারের জন্য অর্থব্যয় করিতে কুষ্ঠিত। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিমিত আয়োজনের উপর নির্ভর করিয়া উদ্ধৃবৃত্তির সাহায্যে আমাদের সাধনায় প্রবৃত্ত হইতে হয়; ফলে আমাদের সিদ্ধিও তদুপযুক্ত হইয়া থাকে। মুষিক যেমন প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াও হস্তীকে পৃষ্ঠে বহন করিতে পারে না‌, আমরাও তেমনই বড় বড় আবিক্রিয়ায় সফল হইতে পারি না; ক্ষুধাক্ষীণ মস্তিষ্ক বৃহতের ধারণা করিতে পারে না।

‘তবু আমি গর্ব করিয়া বলিতে পারি‌, যদি আমরা অর্থের অভাবে পীড়িত না হইয়া অকুণ্ঠ-চিত্তে সাধনা করিতে পারিতাম‌, তাহা হইলে আমরা জগতের কোনও জাতির নিকটেই নূ্যন হইয়া থাকিতাম না। কিন্তু হায়! অর্থ নাই-কমলার কৃপার অভাবে আমাদের বাণীর সাধনা ব্যর্থ হইয়া যাইতেছে। তবু্‌, এই দৈন্য-নির্জিত অবস্থাতেও আমরা যাহা করিয়াছি‌, তাহ নিন্দার বিষয় নহে–শ্লাঘার বিষয়। আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ল্যাবরেটরিতে যে সকল আবিস্ক্রিয়া মাঝে মাঝে অতর্কিতে আবির্ভূত হইয়া আবিষ্কতাঁকে বিস্ময়ে অভিভূত করিয়া ফেলিতেছে‌, কে তাহার সংবাদ রাখে। আবিষ্কারক নিজের গোপন আবিষ্কার সযত্নে বুকে লুকাইয়া নীরবে আরও অধিক জ্ঞানের সন্ধানে ঘুরিতেছে; কিন্তু সে একাকী‌, তাহাকে সাহায্য করিবার কেহ নাই; বরঞ্চ সর্বদাই ভয়‌, অন্য কেহ তাহার আবিষ্কার-কণিকার সন্ধান পাইলে তৎক্ষণাৎ তাহা আত্মসাৎ করিবে। লোলুপ‌, পরস্বগৃধ্নু চোরের দল চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।

‘তই বলিতেছি—অর্থ চাই‌, সহানুভূতি চাই‌, গবেষণা করিবার অবাধ অফুরন্ত উপকরণ চাই‌, সাধনায় সিদ্ধিলাভ করিলে নিষ্কণ্টকে যশোলাভের নিশ্চিন্ত সম্ভাবনা চাই। অর্থ চাই—‘

‘থামো।’

প্রফেসর মহাশয়ের ভাষাটি বেশ গাল-ভরা‌, তাই শব্দপ্রবাহে গা ভাসাইয়া পড়িয়া চলিয়াছিলাম। হঠাৎ ব্যোমকেশ বলিয়া উঠিল‌, ‘থামো।’

‘কি হল?’

‘চাই—চাই–চাই। আর আস্ফালন ভাল লাগে না। বিষের সঙ্গে খোঁজ নেই‌, কুলোপনা চক্কর।‘

আমি বলিলাম‌, ‘ঐ তো মজা। মানুষ নিজের অক্ষমতার একটা-না-একটা সাফাই সর্বদাই তৈরি করে রাখে। আমাদের দেশের আচার্যরাও যে তার ব্যতিক্রম নয়‌, দেবকুমারবাবুর লেকচার পড়লেই তা বোঝা যায়।’

ব্যোমকেশের মুখের বিরক্তি ও অবসাদ ভেদ করিয়া একটা ব্যঙ্গ-বঙ্কিম হাসি ফুটিয়া উঠিল। সে বলিল‌, ‘হাবুল ছোকরা দেখতে হাবাগোবা ভালমানুষ হলেও ভেতরে ভেতরে বেশ বুদ্ধিমান। তার বাবা হয়ে দেবকুমারবাবু এমন ইয়ের মত আদি-অন্তহীন বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান কেন‌, এই আশ্চর্য!’

আমি বলিলাম‌, ‘বুদ্ধিমান ছেলের বাবা হলেই বুদ্ধিমান হতে হবে‌, এমন কোনও কথা নেই। দেবকুমারবাবুকে তুমি দেখেছ?’

‘ঠিক বলতে পারি না। তাঁকে দেখবার দুৰ্নিবার আকাঙ্ক্ষা কখনও প্ৰাণে জাগেনি। তবে শুনেছি‌, তিনি দ্বিতীয় পক্ষে বিবাহ করেছেন। নিবুদ্ধিতার এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি থাকতে পারে?’ বলিয়া ব্যোমকেশ ক্লান্তভাবে চক্ষু মুদিল।

ঘড়িতে সাড়ে আটটা বাজিল। বসিয়া বসিয়া আর কি করিব ভাবিয়া না পাইয়া শেষে পুটরামকে আর এক দফা চা ফরমাস দিব মনে করিতেছি‌, এমন সময় ব্যোমকেশ হঠাৎ সোজা উঠিয়া বসিয়া বলিল‌, ‘সিঁড়িতে কার পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে।’ কিছুক্ষণ উৎকৰ্ণ হইয়া থাকিয়া আবার ঠেসান দিয়া বসিয়া বিরস স্বরে বলিল‌, ‘হাবুল। তার আবার কি হল? বডড তাড়াতাড়ি আসছে।’

0 Shares