অগ্নিবাণ

মুহুর্ত পরেই হাবুল সজোরে দরজা ঠেলিয়া ঘরে ঢুকিয়া পড়িল। তাহার চুল উস্কো খুস্কো‌, চোখ দুটা যেন ভয়ে ও অভাবনীয় আকস্মিক দুর্ঘটনার আঘাতে ঠিকরাইয়া বাহির হইয়া আসিতেছে। এমনিতেই তাহার চেহারাখানা খুব সুদৰ্শন নয়‌, একটু মোটাসোটা ধরনের গড়ন‌, মুখ গোলাকার‌, চিবুক ও গণ্ডে নবজাত দাড়ির অন্ধকার ছায়া-তাহার উপর এই পাগলের মত আবির্ভাব; আমি ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলাম‌, ‘কি হে হাবুল! কি হয়েছে?’

হাবুলের পাগলের মত দৃষ্টি কিন্তু ব্যোমকেশের উপর নিবদ্ধ ছিল; আমার প্রশ্ন বোধ করি সে শুনিতেই পাইল না‌, টলিতে টলিতে ব্যোমকেশের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল‌, বলিল‌, ‘ব্যোমকেশদা‌, সৰ্ব্বনাশ হয়েছে। আমার বোন রেখা হঠাৎ মরে গেছে।’ বলিয়া হাউ হাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল।

ব্যোমকেশ হাবুলকে হাত ধরিয়া একটা চেয়ারে বসাইয়া দিল। কিছুক্ষণ তাহাকে শান্ত করা গেল না‌, সে অসহায়ভাবে কাঁদিতেই লাগিল। বেচারার বয়স বেশি নয়‌, বালক বলিলেই হয়; তাহার উপর অকস্মাৎ এই দারুণ ঘটনায় একেবারে উদভ্ৰান্ত অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল।

হাবুলের যে বোন আছে‌, এ খবর আমরা জানিতাম না; তাহার পরিবারিক খুঁটিনাটি জানিবার কৌতুহল কোনও দিন হয় নাই। শুধু এইটুকু শুনিয়াছিলাম যে‌, হাবুলের মাতার মৃত্যুর পর দেবকুমারবাবু আবার বিবাহ করিয়াছিলেন। বিমাতাটি সপত্নী-পুত্রকে খুব স্নেহের দৃষ্টিতে দেখেন না‌, ইহাও আঁচে-আন্দাজে বুঝিয়েছিলাম।

মিনিট পাঁচেক পরে অপেক্ষাকৃত সুস্থির হইয়া হাবুল ব্যাপারটা খুলিয়া বলিল। দেবকুমারবাবু কয়েক দিন হইল দিল্লী গিয়াছেন; বাড়িতে হাবুল, তাহার অনূঢ়া ছোট বোন রেখা ও তাহাদের সৎমা আছেন। আজ সকালে উঠিয়া হাবুল যথারীতি নিজের তে-তলার নিভৃত ঘরে পড়িতে বসিয়াছিল; আটটা বাজিয়া যাইবার পর নীচে হঠাৎ সৎমার কণ্ঠে ভীষণ চীৎকার শুনিয়া তাড়াতাড়ি নামিয়া আসিল; দেখিল‌, সৎমা রান্নাঘরের সম্মুখে দাঁড়াইয়া ঊর্ধ্বস্বরে প্রলাপ বকিতেছেন। তাঁহার প্রলাপের কোনও অর্থ বুঝিতে না পারিয়া হাবুল রান্নাঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিল, তাহার বোন রেখা উনানের সম্মুখে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া আছে। কি হইয়াছে জানিবার জন্য হাবুল তাঁহাকে প্রশ্ন করিল‌, কিন্তু রেখা উত্তর দিল না। তখন তাহার গায়ে হাত দিয়া নাড়া দিতেই হাবুল বুঝিল‌, রেখা নাই‌, তাহার গা বরফের মত ঠাণ্ডা‌, হাত-পা ক্রমশ শক্ত হইয়া আসিতেছে।

এই পর্যন্ত বলিয়া হাবুল আবার কাঁদিয়া উঠিয়া বলিল‌, ‘আমি এখন কি করব‌, ব্যোমকেশদা? বাবা বাড়ি নেই‌, তাই আপনার কাছে ছুটে এলুম। রেখা মরে গিয়েছে-উঃ! কি করে এমন হল‌, ব্যোমকেশদা?’

হাবুলের এই শোক-বিহ্বল ব্যাকুলতা দেখিয়া আমার চক্ষুও সজল হইয়া উঠিল। ব্যোমকেশ হাবুলের পিঠে হাত দিয়া বলিল‌, ‘হাবুল‌, তুমি পুরুষমানুষ‌, বিপদে অধীর হয়ে না। কি হয়েছিল রেখার‌, বল দেখি–বুকের ব্যামো ছিল কি?’

‘তা তো জানি না।’

‘কত বয়স?’

‘ষোল বছর‌, আমার চেয়ে দু’বছরের ছোট।’

‘সম্প্রতি কোনও অসুখ-বিসুখ হয়েছিল? বেরিবেরি বা ঐ রকম কিছু?’

‘না।‘

ব্যোমকেশ ক্ষণকাল চিন্তা করিল‌, তারপর বলিল‌, ‘চল তোমার বাড়িতে। নিজের চোখে না দেখলে কিছুই ধারণা করা যাচ্ছে না। তোমার বাবাকে ‘তার করা দরকার‌, তিনি এসে পড়ুন। কিন্তু সে দুঘণ্টা পরে করলেও চলবে। আপাতত একজন ডাক্তার চাই। তোমার বাড়ির কাছেই ডাক্তার রুদ্র থাকেন না? বেশ–এস অজিত।’

কয়েক মিনিট পরে দেবকুমারবাবুর বাড়ির সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। বাড়িখানার সম্মুখভাগ সঙ্কীর্ণ যেন দুই দিকের বাড়ির চাপে চ্যাপ্টা হইয়া ঊর্ধ্বদিকে উঠিয়া গিয়াছে। নীচের তলায় কেবল একটি বসিবার ঘর‌, তা ছাড়া ভিতরদিকে কলঘর‌, রান্নাঘর ইত্যাদি আছে। আমরা দ্বারে উপস্থিত হইয়া দাঁড়াইতেই অন্দর হইতে একটা তীক্ষ্ণ স্ত্রীকণ্ঠের ছেদ-বিরামহীন আওয়াজ কনে আসিল। কণ্ঠস্বরে উদ্বেগ ও আশঙ্কার চিহ্ন পূর্ণমাত্রায় থাকিলেও শোকের লক্ষণ বিশেষ পাওয়া গেল না। বুঝিলাম‌, বিমাতা বিলাপ করিতেছেন।

একটা বৃদ্ধ গোছের ভূত্য কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত বাহিরে দাঁড়াইয়া ছিল। ব্যোমকেশ তাহাকে বলিল‌, ‘তুমি এ বাড়ির চাকর? যাও‌, ঐ বাড়ি থেকে ডাক্তারবাবুকে ডেকে নিয়ে এস।’

চাকরিটা কিছু একটা করিবার সুযোগ পাইয়া ‘যে আজ্ঞে বলিয়া দ্রুত প্ৰস্থান করিল। তখন হাবুলকে অগ্রবর্তী করিয়া আমরা ভিতরে প্রবেশ করিলাম।

যাঁহার কণ্ঠস্বর বাহির হইতে শুনিতে পাইয়াছিলাম‌, তিনি উপরে উঠিবার সিঁড়ির সম্মুখে দাঁড়াইয়া একাকী অনর্গল বকিয়া চলিয়াছিলেন‌, আমাদের পদশব্দে তাঁহার চমক ভাঙিলা; তিনি উচ্চকিতভাবে আমাদের পানে চাহিলেন। দুইজন অপরিচিত লোককে হাবুলের সঙ্গে দেখিয়া তিনি মাথার উপর আঁচলটা টানিয়া দিয়া ক্ষিপ্ৰপদে উপরে উঠিয়া গেলেন। আমি মুহুর্তের জন্য তাঁহার মুখখানা দেখিতে পাইয়াছিলাম। আমার মনে হইল‌, তাঁহার আরক্ত চোখের ভিতর একটা ত্ৰাস-মিশ্রিত বিরক্তির ছায়া দেখা দিয়াই অঞ্চলের আড়ালে ঢাকা পড়িয়া গেল।

হাবুল অফুটম্বরে বলিল‌, ‘আমার মা–”

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বুঝেছি। রান্নাঘর কোনটা?’

হাবুল অঙ্গুলি নির্দেশে দেখাইয়া দিল। অল্প-পরিসর চতুষ্কোণ উঠান ঘিরিয়া ছোট ছোট কয়েকটি কক্ষ; তাহার মধ্যে যেটি অপেক্ষাকৃত বড়‌, সেইটি রান্নাঘর। পাশে একটি জলের কল‌, তাহা হইতে ক্ষীণ ধারায় জল পড়িয়া দ্বারের সম্মুখভাগ পিচ্ছিল করিয়া রাখিয়াছে।

0 Shares