হাবুল ঘাড় নাড়িল।
ডাক্তার রুদ্রের উত্থিত-ভ্রূ-ললাটে ঈষৎ কৌতুহল প্রকাশ পাইল। তিনি মৃতদেহের পানে তাকাইয়া বলিলেন, ‘এরই নাম রেখা?’
হাবুল আবার ঘাড় নাড়িল।
‘কি হয়েছিল?’
‘কিছু না–হঠাৎ–‘
ডাক্তার রুদ্র তখন হাঁটু গাড়িয়ে রেখার পাশে বসিলেন; মুহূর্তের জন্য একবার নাড়িতে হাত দিলেন, একবার চোখের পাতা টানিয়া চক্ষু-তারকা দেখিলেন। তারপর উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, ‘মারা গেছে। প্রায় দুঘণ্টা আগে মৃত্যু হয়েছে। Rigor mortis set in করেছে।’ কথাগুলি তিনি এমন পরিতৃপ্তির সহিত বললেন—যেন অত্যন্ত সুসংবাদ শুনিবামাত্র শ্রোতারা খুশি হইয়া উঠিবে।
ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল, ‘কিসে মৃত্যু হয়েছে, বলতে পারেন কি?’
‘সেটা অটন্সি না করে বলা অসম্ভব। আমি চললুম–আমার ভিজিট বত্ৰিশ টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দিও। আর, পুলিসে খবর দেওয়া দরকার, মৃত্যু সন্দেহজনক।’ বলিয়া ডাক্তার রুদ্র প্ৰস্থান করিলেন।
৩
রান্নাঘর হইতে বাহিরে আসিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘পুলিশে খবর পাঠানোই উচিত, নইলে আরও অনেক হাঙ্গামা হতে পারে। আমাদের থানার দারোগা বীরেনবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ আছে, আমি তাঁকে খবর দিচ্ছি।’
এক টুকরা কাগজে তাড়াতাড়ি কয়েক ছত্র লিখিয়া ব্যোমকেশ চাকরের হাতে দিয়া থানায় পাঠাইয়া দিল। তারপর বলিল, ‘মৃতদেহ এখন নাড়াচাড়া করে কাজ নেই, পুলিস এসে যা হয় করবে।’ দরজায় শিকল তুলিয়া দিয়া কহিল, ‘হাবুল, একবার রেখার ঘরটা দেখতে গেলে ভাল হত।’
ভারী গলায় ‘আসুন বলিয়া হাবুল আমাদিগকে উপরে লইয়া চলিল। প্রথম খানিকটা কান্নাকাটি করিবার পর সে কেমন যেন আচ্ছন্নের মত হইয়া পড়িয়ছিল; যে যাহা বলিতেছিল, কলের পুতুলের মত তাঁহাই পালন করিতেছিল।
দ্বিতলে গোটা তিনেক ঘর, তাহার সর্বশেষেরটি রেখার; বাকী দুইটি বোধ করি দেবকুমারবাবু ও তাঁহার গৃহিণীর শয়নকক্ষ। রেখার ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, ঘরটি আয়তনে ক্ষুদ্র হইলেও পরিপাটীভাবে গোছানো। আসবাব বেশি নাই, যে কয়টি আছে, বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। এক ধারে একখানি ছোট খাটের উপর বিছানা; অপর দিকে জানালার ধারে লিখিবার টেবিল। পাশে ক্ষুদ্র সেলফে দুই সারি বাঙ্গালা বই সাজানো। দেয়ালে ব্র্যাকেটের উপর একটা আয়না, তাহার পদমূলে চিরুণী, চুলের ফিতা, কাঁটা ইত্যাদি রহিয়াছে। ঘরটির সর্বত্র গৃহকর্মে সুনিপুণা ও শিক্ষিতা মেয়ের হাতের চিহ্ন যেন আঁকা রহিয়াছে।
ব্যোমকেশ ঘরের এটা-ওটা নাড়িয়া একবার চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইল, চুলের ফিতা ও কাঁটা লইয়া পরীক্ষা করিল; তারপর জানালার ধারে গিয়া দাঁড়াইল। জানালাটা ঠিক গলির উপরেই; গলির অপর দিকে একটু পাশে ডাক্তার রুদ্রের প্রকাণ্ড বাড়ি ও ডাক্তারখানা। বাড়ির খোলা ছাদ জানালা দিয়া স্পষ্ট দেখা যায়। ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ বাহিরের দিকে তাকাইয়া রহিল; তারপর ফিরিয়া টেবিলের দেরাজ ধরিয়া টানিল।
দেরাজে চাবি ছিল না, টান দিতেই খুলিয়া গেল। দেখিলাম, তাহাতে বিশেষ কিছু নাই; দু’ একটা খাতা, চিঠি লেখার প্যাড, গন্ধদ্রব্যের শিশি, ছুচ-সূতা ইত্যাদি রহিয়াছে। একটা শিশি তুলিয়া লইয়া ব্যোমকেশ দেখিল, ভিতরে কয়েকটা সাদা ট্যাবলয়েড রহিয়াছে। ব্যোমকেশ বলিল, ‘অ্যাসপিরিন। রেখা কি অ্যাসপিরিন খেত?
হাবুল বলিল, ‘হ্যাঁ-মাঝে মাঝে তার মাথা ধরত—’
সম্মুখে আসিয়া স্থির হইয়া দাঁড়াইল। বিছানায় শয়নের চিহ্ন বিদ্যমান, লেপটা এলোমেলোভাবে পায়ের দিকে পড়িয়া আছে, মাথার বালিশ মাথার চাপের দাগ। কিছুক্ষণের জন্য শ্মশান-বৈরাগ্যের মত একটা ভাব মনকে বিষগ্ন করিয়া দিল-এই তো মানুষের জীবন-যাহার শয়নের দাগ এখনও মুখ্য ভূমিলাইয়া যায় নাই, সে প্রভাতে উঠিয়াই কোন অনন্তের পথে যাত্রা করিয়াছে তাহার ঠিকানা নাই।
ব্যোমকেশ অন্যমনস্কভাবে মাথার বালিশটা তুলিল; এক খণ্ড ফিকা সবুজ রঙের কাগজ বালিশের তলায় চাপা ছিল, বালিশ সরাইতেই সেটা প্ৰকাশ হইয়া পড়িল। ব্যোমকেশ সচকিতে কাগজখানা তুলিয়া লইয়া উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিল, ভাঁজকরা চিঠির কাগজ। সে একবার একটু ইতস্তত করিল, তারপর চিঠির ভাঁজ খুলিয়া পড়িতে আরম্ভ করিল।
আমিও গলা বাড়াইয়া চিঠিখানি পড়িলাম। মেয়েলী ছাঁদের অক্ষরে তাহাতে লেখা ছিল—
নস্তুদা,
আমাদের বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে গেল। তোমার বাবা দশ হাজার টাকা চান, অত টকা বাবা দিতে পারবেন না।
আর কাউকে আমি বিয়ে করতে পারব না, এ বোধ হয় তুমি জানো। কিন্তু এ বাড়িতে থাকাও আর অসহ্য হয়ে উঠেছে। আমাকে একটু বিষ দিতে পার? তোমাদের ডাক্তারখানায় তো অনেক রকম বিষ পাওয়া যায়। দিও; যদি না দাও, অন্য যে-কোনও উপায়ে আমি মরব। তুমি তো জানো, আমার কথার নড়াচড় হয় না। ইতি–
তোমার রেখা।
চিঠিখানা পড়িয়ে ব্যোমকেশ নীরবে হাবুলের হাত দিল। হাবুল পড়িয়া আবার ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল, অশ্রু উদ্গলিত কণ্ঠে বলিল, ‘আমি জানতুম এই হবে, রেখা আত্মহত্যা করবে—’
‘নস্তু কে?’
‘নস্তুদা ডাক্তার রুদ্র’র ছেলে। রেখার সঙ্গে ওর বিয়ের সম্বন্ধও হয়েছিল। নস্তুদা বড় ভাল, কিন্তু ঐ চামারটা দশ হাজার টাকা চেয়ে বাবাকে রাগিয়ে দিলে—’
ব্যোমকেশ নিজের মুখের উপর দিয়া একবার হাত চালাইয়া বলিল, ‘কিন্তু—; যাক।‘ তারপর হাবুলের হাত ধরিয়া বিছানায় বসাইয়া স্নিগ্ধস্বরে তাহাকে সান্ত্বনা দিতে লাগিল। হাবুল রুদ্ধস্বরে বলিল, ‘ব্যোমকেশদা, নিজের বলতে আমার ঐ বোনটি ছাড়া আর কেউ ছিল না। মা নেই–বাবাও আমাদের কথা ভাববার সময় পান না–বলিয়া সে মুখে কাপড় দিয়া ফুঁপাইতে লাগিল।