অচিন পাখি

ব্যোমকেশের উত্তর শুনিয়া নীলমণিবাবু মনে মনে সন্তুষ্ট হইয়াছেন মনে হইল। তিনি যখন আবার কথা বললেন তখন তাঁহার কণ্ঠস্বরে একটু ঘনিষ্ঠতার সুর ধ্বনিত হইল। তিনি বলিলেন‌, ‘দেখুন ব্যোমকেশবাবু্‌, পুলিসের কাজে অনেক ঝামেলা। চুনোপুটির কারবারই বেশি‌, রুই-কাৎলা কদাচিৎ মেলে। আবার মজা জানেন‌, ওই চুনোপুটিগুলোকেই ধরতে প্ৰাণ বেরিয়ে যায়‌, রুই-কাৎলা ধরা খুব শক্ত নয়।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তা বটে। ডাক্তারেরা বলেন শক্ত রোগের ওষুধ আছে‌, সর্দি-কাশি সারানোই কঠিন। তা-আপনার চারে যে-কাটি রুই-কাৎলা এসেছে তাদের সকলকেই আপনি খেলিয়ে ডাঙায় তুলেছেন নিশ্চয়।’

নীলমণিবাবু কিছুক্ষণ উত্তর দিলেন না। ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া হাতের নলটি লইয়া নাড়াচাড়া করিতে লাগিলেন। তারপর ব্যোমকেশের দিকে একটি সুতীক্ষ্ণ কটাক্ষ হানিয়া বলিলেন‌, ‘সব মাছই ডাঙায় তুলেছি ব্যোমকেশবাবু্‌, কেবল একটি বাদে। আমার পুলিস-জীবনের শেষ বড় কেস। এই শহরেই ব্যাপারটা ঘটেছিল। কিন্তু কিনারা করতে পারলাম না।’

ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল‌, ‘আসামী কে তা জানতে পেরেছিলেন‌, কিন্তু প্রমাণ পেলেন না?’

নীলমণিবাবু ঈষৎ দ্বিধাভরে বলিলেন‌, ‘একটা লোককে পাকা রকম সন্দেহ করেছিলাম‌, কিন্তু কিছুঁতেই তার অ্যালিবাই ভাঙতে পারলাম না। তারপর এমন একটা ঘটনা ঘটল যে সব ওলট-পালট হয়ে গেল। সত্যিকার আসামী যে কে সে সম্বন্ধে ধোঁকা আর কাটল না।’

‘ই’ বলিয়া ব্যোমকেশ আমার হাত হইতে নল লইল এবং তাকিয়ায় ঠেস দিয়া টানিতে লাগিল। নীলমণিবাবু ব্যোমকেশের উপর চক্ষু স্থির রাখিয়া গড়গড়ায় একটি লম্বা টান দিলেন‌, তারপর নল রাখিয়া দিয়া বলিলেন‌, ‘আপনি গল্পটা শুনবেন?’

ব্যোমকেশ উঠিয়া বসিল‌, বলিল‌, ‘বেশ তো‌, বলুন না। ভারি চমকপ্রদ গল্প হবে মনে হচ্ছে।’

‘চমকপ্রদ কিনা আপনি বিচার করবেন। আমি যা-যা জানি সব আপনাকে বলছি। হয়তো আপনি আসামীকে সনাক্ত করতে পারবেন।’ বলিয়া নীলমণিবাবু একটু হাসিলেন।

ইহা শুধু গল্প শুনাইবার প্রস্তাব নয়‌, ইহার অন্তরালে একটি চ্যালেঞ্জ রহিয়াছে। নীলমণিবাবু যেন ব্যোমকেশকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করিয়া বলিতেছেন-এস দেখি‌, তোমার কত বুদ্ধি প্রমাণ কর।

ব্যোমকেশ কিন্তু রণাহ্বান গায়ে মাখিল না‌, হাসিয়া বলিল‌, ‘আরো না না‌, আপনার মত অভিজ্ঞ পুলিস কর্মচারী যার কিনারা করতে পারেনি‌, আমার দ্বারা কি তা হবে? তবে গল্প শোনার কৌতুহল আছে। আপনি বলুন।’

আমরা নীলমণিবাবুর কাছে সরিয়া আসিয়া বসিলাম। তিনি পকেট হইতে একটা কোটা বাহির করিয়া এক চিমটি জন্দা মুখে দিলেন। পান নয়‌, শুধু জর্দাঁ। ইহাই বোধ হয় তাঁহার আসল Graft

তিনি গলা ঝাড়া দিয়া গল্প আরম্ভ করিবার উপক্রম করিতেছেন‌, বীরেনবাবু ঘরে প্রবেশ করিয়া বলিলেন‌, ‘আর এক দফা চা হবে নাকি? মধ্যাহ্ন ভোজনের এখনো বিস্তর দেরি। বিয়ে-বাড়ির ব্যাপার–

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আসুক চা। এবং সেই সঙ্গে আর এক প্রস্থ তামাক।’

সম্মুখে চায়ের পেয়ালা এবং বাঁ হাতে গড়গড়ার নল লইয়া আমরা বসিলাম। নীলমণি মজুমদার তাঁহার স্বাভাবিক গম্ভীর গলায় গল্প বলিতে আরম্ভ করিলেন। —

রিটায়ার করিবার বছর তিনেক আগে নীলমণিবাবু এই জেলার সদর থানার কর্তা হইয়া আসেন। তাঁহার তিনটি প্রধান গুণ ছিল; যে-বুদ্ধি থাকিলে তদন্তকর্মে কৃতকার্য হওয়া যায় সে-বুদ্ধি তাঁহার প্রচুর পরিমাণে ছিল; তিনি অতিশয় কর্মঠ ছিলেন; এবং তিনি ঘুষ লইতেন না। শহরটা পুলিস সেরেস্তায় দাগী শহর বলিয়া পরিচিত ছিল; খুন-জখম এবং আরও নানা প্রকার অবৈধ ক্রিয়াকলাপ এখানে লাগিয়া থাকিত। নীলমণিবাবু পূর্ব হইতে এ শহরের সহিত পরিচিত ছিলেন‌, শহরের ধাত জানিতেন। তিনি আসিয়া দৃঢ় হস্তে শাসনের ভার তুলিয়া লইলেন।

বছর দেড়েক কাটিয়া গেল। নীলমণিবাবুর সতর্ক শাসনে শহর অনেকটা শান্ত-শিষ্ট ভাবে আছে। নীলমণিবাবুর অভ্যাস ছিল হস্তায় দু’একবার কাহাকেও কিছু না বলিয়া গভীর রাত্রে সাইকেলে চড়িয়া বাহির হইয়া পড়িতেন। শহরের একটা অংশ ছিল বিশেষভাবে অপরাধপ্রবণ; তাহারই অন্ধকার অলিগলিতে তিনি ঘুরিয়া বেড়াইতেন; পাহারাওয়ালারা নিয়মিত রোঁদ দিতেছে কিনা লক্ষ্য করিতেন। তাঁহার সাইকেলে আলো থাকিত না; সঙ্গে থাকিত পিস্তল এবং একটি বৈদ্যুতিক টর্চ। প্রয়োজন হইলে টর্চ জ্বালিতেন।

যে-রাত্রির ঘটনাটা লইয়া এই কাহিনীর আরম্ভ সে-রাত্রে নীলমণিবাবু সাইকেল চড়িয়া যথারীতি বাহির হইয়াছেন। নিষুতি রাত‌, কোথাও জনমানব নাই‌, রাস্তার আলোগুলো দূরে দূরে মিটমিট করিয়া জ্বলিতেছে। ভদ্র পাড়া যেখানে অভদ্র পাড়ার সঙ্গে মিশিয়াছে সেইখানে আম-কাঁঠালের বাগান-ঘেরা কয়েকটা পুরাতন বাড়ি আছে। বাড়িগুলি জীর্ণ‌, আম-কাঁঠালের গাছগুলি বৰ্ষীয়ান। পূর্বে বোধ হয় এই স্থান ভদ্রপল্লীর অন্তর্ভুক্ত ছিল‌, এখন ভদ্রপল্লী ঘৃণাভরে দূরে সরিয়া গিয়াছে; ক্ষয়িষ্ণু বাড়িগুলি দুই পক্ষের মাঝখানে সীমানা রক্ষা করিতেছে। এখানে যাহারা বাস করে তাহাদের সামাজিক অবস্থাও ত্রিশঙ্কুর মত স্বৰ্গ ও মর্তের মধ্যবর্তী।

মন্থর গতিতে সাইকেল চালাইয়া এই পাড়ার ভিতর দিয়া যাইতে যাইতে নীলমণিবাবু দেখিলেন, সম্মুখে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে কয়েকজন লোক একটি মাচার মত বস্তু কাঁধে লইয়া একটি বাড়ির ফটিক হইতে বাহির হইয়া আসিতেছে। তাহদের ভাবভঙ্গী সন্দেহজনক।

নীলমণিবাবু জোরে সাইকেল চালইলেন; কাছাকাছি আসিয়া বৈদ্যুতিক টর্চ জ্বালিয়া লোকগুলার মুখে ফেলিলেন‌, উচ্চকণ্ঠে হুকুম দিলেন‌, ‘দাঁড়াও।’

0 Shares