অচিন পাখি

চারজন লোক ছিল; তাহার একসঙ্গে কাঁধ হইতে মাচা ফেলিয়া পলায়ন করিল‌, মুহূৰ্তমধ্যে অন্ধকারে অদৃশ্য হইয়া গেল। কিন্তু অদৃশ্য হইবার পূর্বে একজনের মুখ নীলমণিবাবু অস্পষ্টভাবে দেখিতে পাইয়াছিলেন; সে ওই বাড়ির মালিক সুরেশ্বর ঘোষ।

পলাতকেরা বিভিন্ন দিকে গিয়াছে‌, নীলমণিবাবু তাহাদের ধরিবার চেষ্টা করিলেন না। তিনি মাচার নিকট গিয়া সাইকেল হইতে নামিলেন‌, এবং মাচার উপর টর্চের আলো ফেলিলেন।

মাচা নয়‌, মড়া বহিবার চালি। তাহাতে বাঁধা-ছাঁদা অবস্থায় পড়িয়া আছে একটি স্ত্রীলোকের দেহ। স্বাস্থ্যুবতী সধবা যুবতী‌, দেহে কোথাও আঘাতের চিহ্ন নাই; কিন্তু মৃত।

নীলমণিবাবু হুইসল্‌ বাজাইলেন। একজন পাহারাওয়ালা কনস্টেবল কাছেপিঠে ছিল‌, দৌড়াইতে দৌড়াইতে আসিল। প্রতিবেশীরাও ঘুম ভাঙিয়া নিজ নিজ গৃহ হইতে বাহির হইল।

প্রতিবেশীরা সকলেই মৃতদেহ সনাক্ত করিল; সুরেশ্বরের স্ত্রী হাসি। বাড়িতে অন্য কেহ থাকে না‌, কেবল সুরেশ্বর ও তাহার স্ত্রী হাসি।

নীলমণিবাবু কনস্টেবলকে থানায় রওনা করিয়া দিলেন‌, তারপর দু’জন প্রতিবেশীকে লইয়া বাড়ি অনুসন্ধান করিলেন। বাড়িটি একতলা হইলেও আকারে ছোট নয়‌, ছয়খানি ঘর। কিন্তু অধিকাংশ ঘরই ব্যবহার হয় না। দুইটি ঘরে ব্যবহারের চিহ্ন পাওয়া যায়; তন্মধ্যে একটি শয়নের ঘর। এই ঘরটি বেশ বড়‌, তাহার দুই পাশে দুইটি খাট। দুইটি খাটেই বিছানা পাতা; একটিতে কেহ শয়ন করে নাই‌, অপরটি দেখিয়া মনে হয় ব্যবহৃত হইয়াছে। কিন্তু বাড়িতে কেহ নাই।

বাগানেও কেহ নাই; বড় বড় আম-কাঁঠালের গাছগুলা সারি দিয়া দাঁড়াইয়া আছে। নীলমণিবাবু প্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসা করিলেন‌, ‘মেয়েটির অসুখ করেছিল। কিনা আপনারা জানেন?

একজন প্রতিবেশী বলিল‌, ‘অসুখ করেনি। আজই বিকেলবেল ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে বিনোদবাবুর সঙ্গে কথা বলছিল?’

‘তাই নাকি! বিনোদবাবু কে?’

‘বিনোদ সরকার‌, সোনারূপের দোকান আছে।’

ফটকের কাছে ফিরিয়া আসিয়া নীলমণিবাবু দেখিলেন‌, থানা হইতে দুইজন সাব-ইন্সপেক্টর ও কয়েকজন জমাদার কনস্টেবল প্রভৃতি আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। তিনি অল্প কথায় ব্যাপার বুঝাইয়া দিয়া একজন সাব-ইন্সপেক্টরের সঙ্গে মৃতদেহ হাসপাতালে রওনা করিয়া দিলেন‌, চারজন কনস্টেবল চালি বহিয়া লইয়া গেল।

প্রতিবেশীরা তখনও কেহ চলিয়া যায় নাই‌, নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করিয়া জল্পনা করিতেছিল। নীলমণিবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন‌, ‘মেয়েটির স্বামীর পুরো নাম কি?’

একজন বলিল‌, ‘সুরেশ্বর ঘোষ।’

‘সে কোথায়?’

প্রতিবেশীরা কিছু বলিতে চায় না; শেষে একজন অনিচ্ছাভরে বলিল‌, ‘সুরেশ্বর সন্ধ্যের পর খেয়ে-দোয়ে বেরিয়ে যায়‌, রাত্রি একটা-দেড়টার আগে বাড়ি ফেরে না।’

‘কোথায় যায়?’

‘শুনেছি কালীকিঙ্কর দাসের দোকানে তাসের আড়ড়া বসে‌, সেখানে যায়।’

‘কালীকিঙ্কর দাসের দোকান কোথায়?’

প্রতিবেশীরা ঠিকানা দিল। নীলমণিবাবু তখন জমাদারকে অকুস্থলে বসাইয়া সাব-ইন্সপেক্টরকে সঙ্গে লইয়া কালীকিঙ্কর দাসের দোকানের উদ্দেশ্যে চলিলেন। প্রতিবেশীদের বলিয়া গেলেন‌, ‘কাল সকালে আসব‌, আপনাদের এজেহার নেব।’

কালীকিঙ্করের দোকান সুরেশ্বরের বাড়ি হইতে আধ মাইল দূরে‌, শহরের নিকৃষ্ট অংশ পার হইয়া যেখানে বাজার-হাট আরম্ভ হইয়াছে সেইখানে। লোহা-লক্কড়ের দোকান। বাজারের এই অংশটির নাম লোহাপটি।

নিষুতি বাজারের ভিতর দিয়া নীলমণিবাবু কালীকিঙ্করের দোকানের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। দোকানের সামনে রাস্তার পাশে ভারী ভারী লোহার ছড় গুচ্ছাকারে পড়িয়া আছে। কিন্তু দোকানের দ্বার বন্ধ। নীলমণিবাবু নিঃশব্দ পদে এদিক-ওদিক ঘুরিয়া দেখিলেন‌, পাশের একটি জানালার ফুটা দিয়া শীর্ণ আলোকরশ্মি বাহিরে আসিতেছে। তিনি সন্তৰ্পণে জানালার কাছে গিয়া ফুটার মধ্যে চক্ষু নিবিষ্ট করিলেন।

তক্তপোশের উপর ফরাস পাতা; চারজন লোক বসিয়া নিবিষ্টমনে তাস খেলিতেছে। তাহাদের মাঝখানে ফরাসের উপর কিছু টাকা ও নোট জমা হইয়াছে। বাজি রাখিয়া খেলা চলিতেছে। তিনি তাসের খেলা।

সাব-ইন্সপেক্টর সাইকেল লইয়া রাস্তায় দাঁড়াইয়া ছিল। নীলমণিবাবু হাত নাড়িয়া তাহাকে ইশারা করিলেন‌, সে সাইকেল রাস্তায় শোয়াইয়া দিয়া দ্বারের সামনে গিয়া দাঁড়াইল। নীলমণিবাবু তখন জানালায় টোকা দিলেন।

চারজন খেলোয়াড় একসঙ্গে জানালার দিকে ঘাড় ফিরাইল‌, চারজোড়া চোখ শঙ্কিত উৎকণ্ঠায় চাহিয়া রহিল; তারপর একজন এক খামচায় সম্মুখের টাকাকড়ি তুলিয়া লইয়া পকেটে পুরিল।

নীলমণিবাবু কড়া সুরে বলিলেন‌, ‘দোর খোল।’

চারজন মুখ তাকাতাকি করিল‌, তারপর একজন গলা উচু করিয়া বলিল‌, ‘কে?’

নীলমণিবাবু বলিলেন‌, ‘পুলিস। দোর খোল।’

আবার খেলোয়াড়দের মধ্যে মুখ তাকাতাকি। তারপর একজন‌, বোধ হয় দোকানের মালিক কালীকিঙ্কর দাস‌, উঠিয়া গেল। নীলমণিবাবু জানালা হইতে সরিয়া দ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইলেন। দ্বার খুলিল। রোগা অস্থিসার লোকটা দুইজন ইউনিফর্ম পরা পুলিস কর্মচারীকে দেখিয়া এক পা পিছাইয়া গেল‌, ‘কে! কি চাই?’

নীলমণিবাবু বলিলেন‌, ‘তুমি কালীকিঙ্কর দাস?’

‘হ্যাঁ। কি চাই?’

‘এখানে আর কে কে আছে?’

কালীকিঙ্কর ঢোক গিলিয়া বলিল‌, ‘আমার তিনজন বন্ধু আছে।’

নীলমণিবাবু আর বাক্যব্যয় করিলেন না‌, ইন্সপেক্টরকে সঙ্গে লইয়া দোকানে প্রবেশ করিলেন। পাশে অফিস-ঘরের দরজা; অফিস-ঘরে গিয়া তিনি দেখিলেন‌, তিনজন খেলোয়াড়। তখনও ফরাসের উপর বসিয়া আছে‌, একজন তাস ভাঁজিতেছে। তিনি কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া সকলকে নিরীক্ষণ করিলেন। সকলেরই বয়স পয়ত্ৰিশ হইতে চল্লিশের মধ্যে‌, চেহারায় কোনও বৈশিষ্ট্য নাই। কেবল এক ব্যক্তি‌, যে-ব্যক্তি তাস ভাঁজিতেছিল‌, হাড়ে-মাসে মজবুত গোছের লোক। দেখিয়া মনে হয় এই লোকটাই পালের গোদা।

0 Shares