নীলমণিবাবু প্রশ্ন করিলেন, ‘সুরেশ্বর ঘোষ কর নাম?’
মজবুত লোকটি ভুরু তুলিয়া চাহিল, তারপর তাস রাখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, ‘আমি সুরেশ্বর ঘোষ। কি দরকার? তার স্বর শান্ত ও সংযত।
নীলমণিবাবু একে একে চারজনের দিকে চক্ষু ফিরাইয়া বলিলেন, ‘তোমরা দুপুর রাত্রে মড়া নিয়ে ঘাটে পোড়াতে যাচ্ছিলে। ভেবেছিলে একবার পুড়িয়ে ফেলতে পারলে আর কোনো ভয় নেই।’
চারজনের মুখেই অকৃত্রিম বিস্ময় ফুটিয়া উঠিল। সুরেশ্বর বলিল, ‘মড়া! কি বলছেন। কার মড়া?’
নীলমণিবাবু বলিলেন, ‘ন্যাকামি করে পর পাবে না। আমি দেখেছি তোমাকে। যে-চারজন মড়া নিয়ে যাচ্ছিল, তুমি তাদের একজন।’
সুরেশ্বর বলিল, ‘কবেকার কথা বলছেন?’
‘আজকের কথা বলছি। আজ রাত্ৰি বারোটার কথা।’
‘বাজে কথা বলছেন। আজ রাত্রি সাড়ে আটটার সময় আমরা এখানে তাস খেলতে বসেছি, এক মিনিটের জন্যে কেউ বাইরে যাইনি।’
‘বটে! সারাক্ষণ তাস খেলেছ! জুয়া?’
তিনজনে ঘাড় চুলকাইতে লাগিল। সুরেশ্বর কিন্তু তিলমাত্র অপ্রতিভ না হইয়া বলিল, ‘হ্যাঁ, জুয়া খেলছিলাম। আমরা চার বন্ধু মিলে মাঝে মাঝে খেলি।’
নীলমণিবাবু দেখিলেন। এখানে ইহাদের কাবু করা যাইবে না, থানায় লইয়া যাইতে হইবে। বলিলেন, ‘আপাতত জুয়া খেলার অপরাধে আমি তোমাদের অ্যারেস্ট করছি। থানায় চল।’
অতঃপর কিছুক্ষণ কথা-কাটাকাটি চলিল, শেষ পর্যন্ত তাহারা থানায় যাইতে রাজী হইল। নীলমণিবাবু বলিলেন, ‘যদি জামিন যোগাড় করতে পোর, আজ রাত্তিরেই ছেড়ে দেব।’
রাস্তায় কিছুদূর যাইবার পর সুরেশ্বর বলিল, ‘মড়ার কথা কী বলছিলেন? কার মড়া?’
নীলমণিবাবু বলিলেন, ‘তোমার স্ত্রীর।’
সুরেশ্বর রাস্তার মাঝখানে দাঁড়াইয়া পড়িল, ‘অ্যাঁ! আমার স্ত্রী! কি বলছেন আপনি?’
‘বলছি, তোমার স্ত্রী খুন হয়েছে।’
‘না না! এসব কি রকম কথা! আমি বিশ্বাস করি না। হাসি!–না, আমি বাড়ি চললাম।’
‘বাড়ি গিয়ে কোন লাভ নেই। মৃতদেহ হাসপাতালে চালান দেওয়া হয়েছে।’
থানায় পৌঁছিয়া নীলমণিবাবু চারজনকে হাজতে পুরিলেন। তারপর অফিসে বসিয়া একে একে তাহাদের জেরা আরম্ভ করিলেন। প্রথমে ডাকিলেন সুরেশ্বরকে। সে টেবিলের পাশের একটি চেয়ারে উপবিষ্ট হইলে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি কি কাজ কর?’
সুরেশ্বর বলিল, ‘অনেক রকম ব্যবসা আছে। পাইকিরি ব্যবসা। আমি পয়সাওয়ালা লোক, পুচকে দোকানদার নই।’
‘বাড়িটা তোমার?’
‘হ্যাঁ।’
‘কতদিন কিনেছ?’
‘পাঁচ-ছয় বছর হবে। উনিশ হাজার টাকায় কিনেছিলাম।’
নীলমণিবাবুকে টাকার কথা শুনাইয়া লাভ হইল না, তিনি অটলভাবে প্রশ্ন করিয়া চলিলেন, ‘কতদিন আগে বিয়ে করেছিলে?’
‘সাত বছর আগে।’
‘শ্বশুরবাড়ি কোথায়?
‘এই শহরে।’
‘শ্বশুরের নাম কি?’
‘দিনমণি হালদার।’
‘সে এখন কোথায়?’
‘জানি না। সম্ভবত জেলে।’
‘জেলে?’
‘হ্যাঁ। জেল আমার শ্বশুরের ঘর-বাড়ি।’
‘হুঁ। শ্বশুরের সঙ্গে তোমার সদ্ভাব আছে?’
‘মুখ দেখাদেখি নেই।’
নীলমণিবাবু কিছুক্ষণ চক্ষু কুঞ্চিত করিয়া রহিলেন। শেষে বলিলেন, ‘বৌয়ের সঙ্গে তোমার সদ্ভাব ছিল?’
একটু দ্বিধা করিয়া সুরেশ্বর বলিল, বিয়ের সাত বছর পরে যতটা সম্ভাব থাকা সম্ভব ততটা
‘ছেলে-পিলে নেই?’
‘না। বৌ বাঁজা।’
নীলমণিবাবু আঙুল তুলিয়া বলিলেন, ‘আজ রাত্ৰি বারোটার সময় তুমি আর তোমার বন্ধুরা মিলে তোমার স্ত্রীর মৃতদেহ বাড়ি থেকে বার করে নিয়ে যাচ্ছিলে, আমি টর্চের আলো ফেলে তোমাকে দেখেছি।’
সুরেশ্বর নিরুত্তাপ কষ্ঠে বলিল, ‘আপনি ভুল দেখেছেন। রাত্ৰি বারোটার সময় আমি আর আমার বন্ধুরা কালীকিঙ্করের দোকানে বসে তাস খেলছিলাম।’
‘হুঁ। তোমার স্ত্রীর স্বভাব-চরিত্র কেমন ছিল?’
‘মেয়েমানুষের স্বভাব-চরিত্রের কথা কে বলতে পারে? তবে পাড়া-পড়াশীরা বদনাম দিত।’
‘কি বদনাম দিত?
‘আমি রাত্রি করে বাড়ি ফিরি। কয়েক মাস থেকে কে একজন নাকি বাগানে এসে হাসির সঙ্গে দেখা করত।’
‘স্ত্রীকে এ বিষয়ে কিছু জিগ্যেস করেছিলে?’
‘করেছিলাম। সে বলেছিল সব মিথ্যে কথা।’
‘আর কিছু?
‘আর কি! একবার হাসির আলমারি খুলে তার মধ্যে এমন কয়েকটা গয়না দেখেছিলাম যা আমি তাকে দিইনি।’
‘কোথা থেকে গয়না এল বৌয়ের কাছে খোঁজ নিয়েছিলে?’
‘কি হবে খোঁজ নিয়ে? মেয়েমানুষ যদি নষ্ট হতে চায় কেউ তাকে আটকাতে পারে না।’
‘কিন্তু খুন করতে পারে।’
‘আমি হাসিকে খুন করিনি।’
নীলমণিবাবু আরও অনেকক্ষণ নানাভাবে জেরা করিলেন, কিন্তু সুরেশ্বরকে টলাইতে পারিলেন না। বরং তাহার ঠোঁট-কাটা স্পষ্টবাদিত দেখিয়া মনে হয় সে সত্য কথা বলিতেছে।
সুরেশ্বরকে হাজতে ফেরৎ পাঠাইয়া নীলমণিবাবু কালীকিঙ্করকে ডাকিয়া আনিলেন। কালীকিঙ্করীরের হাড়-বাহির-করা শরীরের মধ্যে লৌহ-কঠিন একটি মন ছিল, নীলমণি অনেক চেষ্টা করিয়াও তাহা বাঁকাইতে পারিলেন না। চার বন্ধু রাত্রি সাড়ে আটটার সময় তাহার দোকানে তাস খেলিতে বসিয়াছিল, নীলমণিবাবু আসা পর্যন্ত এক মুহুর্তের জন্যও কেহ বাহিরে যায় নাই, এ কথার নড়চড় হইল না।
অন্যান্য বিষয়ে কিন্তু কালীকিঙ্কর সোজাসুজি উত্তর দিল। সুরেশ্বর তাহার আজীবনের বন্ধু, তাহার ঘরের খবর সবই কালীকিঙ্কর জানে। সুরেশ্বরের অবস্থা আগে ভাল ছিল না, যুদ্ধের বাজারে সে পয়সা করিয়াছে। হাসিকে সে বিবাহ করিয়াছিল গরীব অবস্থায়। হাসির ব্যাপটা ছিল। একাধারে চোর এবং বোকা; চুরি করিয়া ধরা পড়িয়া যাইত এবং জেলে যাইত। হাসির মায়েরও বদনাম ছিল। বস্তিতে বাস করিলে ভদ্রলোকের মেয়েরও চালচলন খারাপ হইয়া যায়; যেমন দেখিবে তেমনি তো শিখিবে। হাসির বাপ যখন জেলে থাকিত তখন নাকি হাসির মায়ের ঘরে লোক আসিত। সুরেশ্বর যখন হাসিকে বিবাহ করিতে উদ্যত হয়, তখন বন্ধুরা সকলেই মানা করিয়াছিল; কিন্তু সুরেশ্বর কাহারও কথা শুনিল না। তারপর যুদ্ধের বাজারে সুরেশ্বর টাকা করিয়াছে, বাড়ি কিনিয়াছে; কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তেমন বনিবনাও নাই। সুরেশ্বর বাড়িতে বেশি থাকে না, বাহিরে বাহিরে দিন কটায়। কিন্তু তাই বলিয়া সে স্ত্রীকে খুন করিয়াছে একথা একেবারেই সত্য নয়। সুরেশ্বর তেমন লোকই নয়। সে ভদ্র সন্তান; জীবনের আরম্ভে অনেক দুঃখ-কষ্ট পাইয়া বস্তিতে থাকিয়া বড় হইয়াছে বটে, কিন্তু তার মনটা খুব উঁচু।