অচিন পাখি

কালীকিঙ্করের বন্ধু-প্রশস্তি শেষ হইলে নীলমণিবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘সুরেশ্বরের শ্বশুর দিনমণি হালদার এখন কোথায়?’

কালীকিঙ্কর বলিল‌, ‘বছর দুই আগে দিনু হালদার জেল থেকে বেরিয়ে এখানে এসেছিল। হাসির মা তখন মরে গেছে। দিনু হালদার দু’তিন দিন মেয়ে-জামাইয়ের কাছে ছিল। একদিন সুরেশ্বরের সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গেল। দিনু হালদার কোথায় চলে গেল। তারপর থেকে আর তাকে দেখিনি। বয়স হয়েছিল‌, জেল খেটে শরীরও ভেঙে পড়েছিল। হয়তো মরে গেছে।’

অতঃপর নীলমণিবাবু কালীকিঙ্করকে ফেরৎ পাঠাইয়া দেবু মণ্ডলকে আনাইলেন। দেবু মণ্ডল কয়লা ও জ্বালানি কাঠের ব্যবসা করে; বিত্তবান ব্যক্তি। সুরেশ্বরের বাল্যবন্ধু‌, সুখে-দুঃখে। নিত্য-সহচর। সুরেশ্বরের স্ত্রীকে খুন করিয়া তাহারা পোড়াইতে লইয়া যাইতেছিল একথা সর্বৈব মিথ্যা। তাহারা তাস খেলিতেছিল। বন্ধু-পত্নীর চরিত্র সম্বন্ধে মতামত প্রকাশ করিতে সে অক্ষম; তবে হাসি সদ্যবংশের মেয়ে ছিল না একথা যথার্থ।

দেবু মণ্ডলকে নীলমণিবাবু ভাঙিতে পারিলেন না‌, নূতন কোনও তথ্যও আবিষ্কৃত হইল না। তিনি অবশেষে বলিলেন‌, ‘শ্মশান ঘাটে তোমার কাঠের আড়ৎ আছে?’

দেবু মণ্ডল থতমত খাইয়া বলিল‌, ‘আছে। শহরে দুটো আড়ৎ আছে‌, আর শ্মশানে একটা।’

নীলমণিবাবু কুঞ্চিত চক্ষে কিছুক্ষণ তাহার পানে চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন‌, ‘এবার সত্যি কথা বলবো?

দেবু মণ্ডল বলিল‌, ‘সত্যি কথাই বলছি।’

চতুর্থ ব্যক্তির নাম বিলাস দত্ত। ঠিকাদারদের কাজ করে‌, বিলডিং কনট্র্যাক্টর; অতিশয় মিষ্টভাষী ও রসিক। নীলমণিবাবুকে একটি অশ্লীল রসিকতা শুনাইয়া ঘাড় নিচু করিয়া জিভ কাটিল। তাঁস খেলার ব্যাপার সম্বন্ধে কিন্তু তাহার মনে লেশমাত্র সংশয় নাই। নীলমণিবাবু দেখিলেন বিলাস দত্ত যে শ্রেণীর লোক‌, সে অজস্র মিথ্যা কথা বলিবে কিন্তু কাজের কথা একটিও বলিবে না। তিনি হতাশ হইয়া বলিলেন‌, ‘তুমি ঠিকাদার‌, তোমার অনেক বাঁশ আছে?’

বিলাস দত্ত বলিল‌, ‘বাঁশ! আছে বৈকি‌, এন্তার বাঁশ আছে। ভারা বাঁধবার জন্যে দরকার হয় কিনা।’

নীলমণিবাবু বলিলেন‌, ‘হুঁ, মড়ার চালি বাঁধবার জন্যেও দরকার হয়।’

বন্ধু চতুষ্টয়ের জেরা শেষ করিতে রাত কাবার হইয়া গেল।

পরদিন। কিন্তু তাহদের আর হাজতে আটকাইয়া রাখা গেল না। তাহদের উকিল জামিন দিয়া তাহদের খালাস করিয়া লইয়া গেলেন। নীলমণিবাবুর মনে অভ্রান্ত বিশ্বাস জন্মিয়ছিল যে, সুরেশ্বর ঘোষ স্ত্রীকে খুন করিয়াছে এবং বাকি তিনজন এই ব্যাপারে লিপ্ত আছে। কিন্তু প্রমাণ নাই; তিনি যাহা চোখে দেখিয়াছেন তাহার কোন সমর্থক নাই; তাঁহার সাক্ষ্য উকিলের জেরায় উড়িয়া যাইবে। তাই বর্তমানে তিনি তাহাদের নামে খুনের অভিযোগ আনিতে পারিলেন না। কেবল জুয়া খেলার অভিযোগেই তাঁহাকে সন্তুষ্ট থাকিতে হইল।

তিনি কিন্তু খুনের তদন্তে বিরতি দিলেন না। তিনি দুইজন সহকারী লইয়া সুরেশ্বরের প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেখা করিলেন‌, তাহদের বয়ন শুনিলেন। শেষে বেলা প্ৰায়‌, একটার সময় সুরেশ্বরের বাড়িতে গেলেন। ফটকে একজন কনস্টেবল পাহারায় ছিল‌, সে বলিল‌, সুরেশ্বর বেলা এগারোটা নাগাদ ফিরিয়া আসিয়াছে এবং বাড়িতে আছে।

নীলমণিবাবু গৃহে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন‌, সুরেশ্বর শয়নকক্ষের একটা খাটে শুইয়া ঘুমাইতেছে। পুলিসের জুতার শব্দে সে রক্তবর্ণ চক্ষু মেলিয়া উঠিয়া বসিল‌, জড়িত স্বরে বলিল‌, ‘আবার কী চাই?’

নীলমণিবাবু বলিলেন‌, ‘আমরা বাড়ি তল্লাশ করতে এসেছি।’

‘করুন তল্লাশ। যা ইচ্ছে করুন।’ বলিয়া সে আবার শয়নের উপক্রম করিল। তাহার বোধ হয় বেলা পর্যন্ত ঘুমানো অভ্যাস‌, তার উপর কাল সারা রাত্রি জাগরণে গিয়াছে‌, আজ বোধ হয় সারা দিন ঘুমাইবে। কিন্তু–স্ত্রীর মৃত্যুতে তাহার মনে কি একটুও দাগ পড়ে নাই? খুন করুক বা না করুক‌, এমন নিশ্চিন্ত ভাবে ঘুমাইতেছে কি করিয়া!

যাহোক‌, নীলমণিবাবু তাহাকে ঘুমাইতে দিলেন না। বলিলেন‌, ‘তোমার স্ত্রীর গয়নাগুলো দেখতে চাই।’

সুরেশ্বর বিরক্ত মুখে উঠিয়া একটা দেয়াল-আলমারির কপাট খুলিল‌, তাহার একটা তাকে কাপড়-চোপড়ের পেছন হইতে এক থাবা সোনার গহনা বাহির করিল। আটপৌরে গহনা কিছু আছে‌, তাছাড়া তোলা গহনা। নীলমণিবাবু বলিলেন‌, ‘এর মধ্যে কোন গয়না তুমি দাওনি?

সুরেশ্বর একটা আংটি‌, এক জোড়া কানের দুল‌, একটা চুলের কাঁটা বাছিয়া তাঁহার হাতে দিল। এ গহনাগুলি নূতন‌, ব্যবহৃত হয় নাই।

নীলমণিবাবু সেগুলি নিজের পকেটে রাখিয়া বলিলেন‌, ‘এগুলো আমি রাখছি। পরে ফেরৎ দেব।’

তারপর তাহার সমস্ত বাড়ি ও বাগান তন্ন তন্ন করিলেন‌, কিন্তু এমন কিছুই পাওয়া গেল না। যাহা হইতে হাসির মৃত্যুর কোন হদিস পাওয়া যায়।

বৈকালে সাড়ে তিনটার সময় নীলমণিবাবু সুরেশ্বরের বাড়ির তদন্ত শেষ করিলেন এবং সহকারীদের ফেরৎ পাঠাইয়া নিজে বিনোদ সরকারের দোকানের দিকে চলিলেন। বাজারের মধ্যে বিনোদ সরকারের সোনা-রূপার দোকানটা তাঁহার দেখা ছিল‌, বেশ বড় দোকান‌, দোকানের মধ্যে কারিগরদের কাজ করিবার কারখানা।

বিনোদবাবু দোকানে ছিলেন‌, একটি সুসজ্জিত কক্ষে টেবিলের সামনে বসিয়া গড়গড়ায় তামাক টানিতেছিলেন। লোকটির বয়স অনুমান পঞ্চাশ‌, কিন্তু ভারি শৌখিন মানুষ। গায়ে তসরের পাঞ্জাবি‌, গিলে করা ফরাসডাঙার ধুতি‌, গোঁফের উপর-নিচে কামাইয়া অত্যন্ত সূক্ষ্ম করিয়া তোলা হইয়াছে‌, মাথার সম্মুখ ভাগে এক গোছা চুল তিনদিক হইতে টাকের আক্রমণ কোনমতে ঠেকাইয়া রাখিয়াছে। আকৃতি একটু খর্ব‌, কিন্তু তদনুপাতে বেশ গোলগাল।

0 Shares