অচিন পাখি

পুলিস দেখিয়া তিনি একটু বিব্রত হইলেন‌, বলিলেন‌, ‘কি ব্যাপার বলুন তো? আমার দোকানে কি কোন গণ্ডগোল হয়েছে?’

নীলমণিবাবু সামনের চেয়ারে বসিলেন‌, বলিলেন‌, না। আপনার কাছে কিছু খবর জানতে এসেছি।’

বিনোদবাবু ধাতস্থ হইলেন‌, নীলমণিৰাবুর দিকে পানের ডিবা ও জদার কোটা বাড়াইয়া দিয়া বলিলেন‌, ‘কি খবর?’

নীলমণিবাবু পান লইলেন না‌, জদার কোটা হইতে এক চিমটি জাদা লইয়া মুখে দিলেন‌, ধীরে ধীরে বলিলেন‌, ‘সুরেশ্বর ঘোষের স্ত্রী মারা গেছে আপনি জানেন?’

বিনোদবাবু চেয়ার হইতে প্রায় লাফাইয়া উঠিলেন‌, ‘হাসি মারা গেছে! সে কি! কাল বিকেলে যে আমি তাকে দেখেছি।’

‘কাল রাত্রে মারা গেছে।’

‘রাত্ৰে! কিন্তু বিকেলবেলা সে তো ভালই ছিল। কিসে মারা গেল? কী হয়েছিল তার?’ ‘আমার বিশ্বাস কাল রাত্রে তাকে খুন করা হয়েছে।’

‘খুন!’ বিনোদবাবু আস্তে আস্তে চেয়ারে বসিলেন‌, কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকাইয়া থাকিয়া হঠাৎ টেবিলের উপর প্রচণ্ড চাপড় মারিয়া বলিলেন‌, ‘সুরেশ্বর খুন করেছে। ও ছাড়া আর কেউ নয়।’

‘সুরেশ্বরের কিন্তু অকাট্য অ্যালিবাই আছে।’

‘থাক‌, অ্যালিবাই‌, এ সুরেশ্বরের কাজ। সুরেশ্বর আর ওর ওই তিনটে বন্ধু মহা ধূর্ত আর পাজি। ওদের অসাধ্য কোজ নেই।’

নীলমণিবাবু বলিলেন‌, ‘আপনি হাসিকে অনেক দিন থেকে চেনেন?’

‘ওকে তিন-চার বছর বয়স থেকে দেখে আসছি।’ তিনি নলটি মুখ হইতে লইয়া কিছুক্ষণ তাহার অগ্রভাগ পরিদর্শন করিলেন‌, একবার নীলমণিবাবুর দিকে চকিত কটাক্ষ নিক্ষেপ করিলেন; তারপর হ্রস্ব স্বরে বলিলেন‌, ‘আপনি পুলিস‌, আপনার কাছে লুকোব না‌, কম বয়সে আমি একটু-ইয়ে-হাসির মায়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। সে আজ বিশ-বাইশ বছর আগেকার কথা। হাসির ব্যাপটা ছিল। হতভাগা চোর‌, নেশাখোর‌, জালিয়াৎ। স্ত্রী-কন্যাকে খেতে দিতে পারত না। হাসির মা পেটের দায়ে-কিন্তু সে যাক। বছর কয়েক আগে হাসির মা মারা গেল। মৃত্যুকালে আমাকে ডেকে মিনতি করে বলে গিয়েছিল‌, হাসিকে তুমি দেখো‌, জামাইয়ের মন ভাল নয়।–তার মৃত্যু-শয্যার অনুরোধ আমি এড়াতে পারিনি; হাসিকে মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসতাম। হাসির মা সতীসাধবী ছিল না‌, কিন্তু তার প্রকৃতি ছিল বড় মধুর।’

কিছুক্ষণ আর কোন কথা হইল না। তারপর নীলমণিবাবু বলিলেন‌, ‘তাহলে আপনার সন্দেহ সুরেশ্বরবাবু হাসিকে খুন করেছে?’

বিনোদবাবু যেন স্মৃতি-সমূত্রের তলদেশ হইতে উঠিয়া আসিলেন‌, ‘অ্যাঁ! হ্যাঁ, আমার তাই বিশ্বাস।‘

‘কিন্তু কেন? মোটিভ কি?’

‘দেখুন‌, সুরেশ্বর যখন হাসিকে বিয়ে করেছিল‌, তখন তার চালচুলো কিছু ছিল না। তারপর যুদ্ধের বাজারে সে বড়লোক হল। তখন তার উচ্চাশা হল সে ভদ্রসমাজে মিশবে‌, দশজনের একজন বলে গণ্য হবে। কিন্তু হাসি বেঁচে থাকতে সে-সম্ভাবনা নেই; হাসির মা-বাপের কেচ্ছা! শহরে কে না জানে? তাই সুরেশ্বর হাসিকে মেরেছে। এবার নতুন বিয়ে করে ভদ্রলোক হয়ে বসবে।’

‘হাসির স্বভাব-চরিত্র কেমন ছিল?’

‘হেলাগোলা মেয়ে ছিল‌, মনে ছল-কপট ছিল না। একটু হয়তো পুরুষ-ঘেঁষা ছিল‌, ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে থাকত‌, রাস্তা দিয়ে লোক গেলে ডেকে কথা কইত। কিন্তু তাতেও তাকে দোষ দেওয়া যায় না। পাড়ার মেয়েরা ওর সঙ্গে ভাল করে কথা বলত না‌, কেউ বা বাঁকা কথা বলত। হাসিও তো মানুষ‌, তারও তো কথা কইবার দুটো লোক দরকার। আমি জোর করে বলতে পারি‌, অন্য দোষ তার যতাই থাক‌, মন্দ সে ছিল না।’

নীলমণিবাবু কোটা হইতে আর এক টিপ জব্দ মুখে দিলেন‌, তারপর পকেট হইতে গহনাগুলি বাহির করিয়া বিনোদবাবুর সম্মুখে রাখিলেন‌, ‘দেখুন তো‌, এগুলো চিনতে পারেন?

‘হাসির গয়না নাকি?’ বলিয়া বিনোদবাবু সেগুলি হাতে তুলিয়া লইলেন‌, তারপর মাথা নাড়িয়া বলিলেন‌, ‘এ গয়না। আমি হাসিকে কখনো পরতে দেখিনি।’

‘আপনি কখনো তাকে গয়না উপহার দেননি?’

বিনোদবাবু মাথা নাড়িলেন‌, ‘না। আমি তাকে পুজো আর দোলের সময় একখানা করে শাড়ি দিতাম। গয়না কখনো দিইনি।’

নীলমণিবাবু বলিলেন‌, ‘এ গয়না কি আপনার দোকানে তৈরি?’

বিনোদবাবু ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া গহনাগুলি আবার পরীক্ষা করিলেন‌, বলিলেন‌, ‘না‌, এ গয়না আমার কারিগরের তৈরি নয়। কিন্তু‌, দাঁড়ান—’ তিনি ঘণ্টি টিপিয়া চাকরকে ডাকিলেন-‘রামদয়ালকে পাঠিয়ে দাও।’

চশমা চোখে বয়স্থ কারিগর রামদয়াল আসিলে, তাহার হাতে গহনাগুলি দিয়া বলিলেন, ‘দেখ তো‌, এ গয়না কি আমাদের তৈরি?’

রামদয়াল ভাল করিয়া দেখিয়া বলিল‌, ‘আজ্ঞে না‌, এ গয়না। কলকাতার কারিগরের তৈরি।’

‘আচ্ছা‌, যাও।’

নীলমণিবাবুও উঠিলেন, গহনাগুলি পকেটে রাখিয়া বলিলেন, ‘আজ তবে উঠি, যদি দরকার হয় আবার আসব।’

‘যখন ইচ্ছে আসবেন।’

সেদিন সন্ধ্যাকালে নীলমণিবাবু সিভিল সার্জন মেজর বর্মণের বাংলোতে গেলেন। বাংলোতেই অফিস। মেজর বর্মণ দিনের কাজ শেষ করিয়া উঠি-উঠি করিতেছেন‌, নীলমণিবাবু বলিলেন‌, ‘খবর নিতে এলাম।’

মেজর বর্মণ বলিলেন‌, ‘বসুন। পি এম করেছি। রিপোর্ট কাল পাবেন।’

‘কি দেখলেন? মৃত্যুর সময়?’

‘আন্দাজ রাত্রি দশটা।’

‘মৃত্যুর কারণ?’

‘যতদূর দেখেছি গায়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল না।’

‘বিষ-টিষ নাকি?’

মেজর বর্মণ একটি সিগার ধরাইয়া তাহাতে মন্দ-মন্থর টান দিলেন‌, ‘বিষ নয়। বড় আশ্চর্ষ উপায়ে মেরেছে। আপনার সন্দেহভাজনের মধ্যে মিলিটারি-ম্যান কেউ আছে নাকি?’

নীলমণিবাবু বলিলেন‌, ‘মিলিটারি-ম্যান কেউ নেই। কিন্তু মেয়েটির স্বামী যুদ্ধের সময় মিলিটারি কষ্ট্র্যাক্টর ছিল‌, গোরাদের সংস্পর্শে এসেছে। কী ব্যাপার বলুন?

0 Shares