অচিন পাখি

মেজর বর্মণ বলিলেন‌, ‘মেয়েটির গায়ে আঘাতের চিহ্ন বাইরে থেকে দেখা যায় না‌, কিন্তু তার গলার তরুণাস্থি‌, যাকে thyroid cartillage বলে‌, সেটা একেবারে চুর্ণ হয়ে গেছে।’

নীলমণিবাবু স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিলেন‌, ‘মানে গলা টিপে মেরেছে।’

‘না। গলা টিপে মারলে চামড়ার ওপর আঙুলের দাগ থাকত। আর‌, গলা টিপে মারার মধ্যে বৈচিত্র্য কিছু নেই।’

‘তবে?’

মেজর বর্মণ কয়েকবার সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়িয়া বলিলেন‌, ‘গত মহাযুদ্ধে সৈনিকদের অস্ত্রহীন যুদ্ধের কৌশল শেখানো হয়েছিল‌, আপনি জানেন?

‘না। সে কি রকম?’

‘মনে করুন বনে-জঙ্গলে যুদ্ধ হচ্ছে। আপনি নিরস্ত্র অবস্থায় একজন সশস্ত্র শত্রুর হাতে ধরা পড়লেন। পালাবার উপায় নেই‌, পালাবার চেষ্টা করলে সে আপনাকে গুলি করে মারবে। এ অবস্থায় আত্মরক্ষার উপায় কি?–আপনি কৌশলে শত্রুর ডান পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন‌, তারপর হঠাৎ তার দিকে ঘুরে ডান হাতের পৌঁচা দিয়ে সজোরে মারলেন তার গলায়। Thyroid cartillage ভেঙে গেল‌, তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হল।’

‘তৎক্ষণাৎ মৃত্যু?’

‘হ্যাঁ। গলা টিপে মারতে গেলে আক্রান্ত ব্যক্তি যুদ্ধ করে মুক্ত হবার চেষ্টা করে। এতে ওসব বালাই নেই‌, সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু।’

নীলমণিবাবু কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলেন‌, ‘আশ্চর্য! মেয়েটির মৃত্যু এইভাবে হয়েছে এতে আপনার সন্দেহ নেই?’

‘কোন সন্দেহ নেই।’

‘আচ্ছা‌, আজ উঠি। কাল সকালে লোক পাঠাব রিপোর্টের জন্যে।’

নীলমণিবাবু থানায় ফিরিয়া আসিলেন। সুরেশ্বর যে হাসিকে খুন করিয়াছে ইহাতে তাঁহার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু একটা ধোঁকা রহিয়াছে। যে লোকটা রাত্রে আসিয়া হাসির সঙ্গে দেখা করিত‌, সে কে? সে-ই কি হাসিকে গহনাগুলো উপহার দিয়াছিল? হাসির সহিত লোকটার কিরূপ সম্বন্ধ? সে যদি হাসির ‘বন্ধু হয় তবে হাসিকে খুন করিবে কেন?

সে-রাত্রে আর কিছু হইল না। পরদিন সকালে একজন সাব-ইন্সপেক্টর ও একজন রাইটার জমাদারকে সঙ্গে লইয়া নীলমণিবাবু আবার সুরেশ্বরের বাড়িতে গেলেন। আজ যেমন করিয়া হোক সুরেশ্বরের নিকট হইতে তিনি স্বীকারোক্তি আদায় করিবেন।

সুরেশ্বরের বাড়ির সদর দরজা খোলা‌, বাড়িতে কেহ আছে বলিয়া মনে হইল না। দুচার বার ডাকাডাকি করিয়া নীলমণিবাবু সঙ্গীদের লইয়া ভিতরে প্রবেশ করিলেন। শয়নকক্ষের খোলা দরজার সামনে গিয়া তাঁহাদের গতি রুদ্ধ হইল। মেঝের উপর সুরেশ্বর মরিয়া পড়িয়া আছে।

গত রাত্রে সুরেশ্বর যথা-নিয়ত কালীকিঙ্করের দোকানে তাস খেলিতে গিয়াছিল। রাত্রি আন্দাজ বারোটার সময় গৃহে ফিরিয়া আসে। তারপর কি হইয়াছে কেহ জানে না।

সিভিল সার্জেন মেজর বর্মণ সুরেশ্বরের মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করিয়া রিপোর্ট দিলেন‌, গলার thyroid cartillage ভাঙিয়া তাহার মৃত্যু হইয়াছে। অর্থাৎ যে উপায়ে হাসির মৃত্যু হইয়াছিল ঠিক সেই উপায়ে সুরেশ্বরেরও মৃত্যু হইয়াছে।

গল্প শেষ করিয়া নীলমণিবাবু কিছুক্ষণ হেঁট মুখে বসিয়া রহিলেন‌, তারপর মুখ তুলিয়া বলিলেন‌, ‘এই হচ্ছে ঘটনা। তদন্তের সূত্রে আমি যা-যা জানতে পেরেছিলাম সব আপনাকে বলেছি। আমি প্রথমে সুরেশ্বরকে সন্দেহ করেছিলাম‌, পরে দেখলাম‌, হাসি আর সুরেশ্বরকে একই লোক একই উপায়ে খুন করেছে। আমি আসামীকে ধরতে পারিনি‌, আসামী কে তাও জানতে পারিনি। আপনি বলতে পারেন কে আসামী?’

ব্যোমকেশ গালে হাত দিয়া শুনিতেছিল‌, বলিল‌, ‘আরো কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দেবেন?’

নীলমণিবাবু বলিলেন‌, ‘উত্তর যদি জানা থাকে নিশ্চয় দেব।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘সুরেশ্বরের ওয়ারিস কে?’

‘সুরেশ্বরের এক খুড়তুতো বোন। সুরেশ্বর উইল করেনি। খুড়তুতো বোনটি অনাথা বিধবা‌, কলকাতায় কোথায় রাঁধুনি-বৃত্তি করত; সেই সব পেয়েছে।’

‘যাক।–যে-রাত্রে সুরেশ্বরের মৃত্যু হয়‌, সে-রত্রে ওর তিন বন্ধু কালীকিঙ্কর‌, দেবু মণ্ডল আর বিলাস দত্ত কোথায় ছিল?’

‘সুরেশ্বরের বাড়ি যাবার পর ওরা তিনজন প্রায় সারা রাত কালীকিঙ্করের দোকানে বসে তাস খেলেছিল। আমি ওদের প্রত্যেকের পিছনে চর লাগিয়েছিলাম‌, তাদের কাছেই খবর পেয়েছি। ওরা সুরেশ্বরকে খুন করেনি।’

‘হুঁ। বিনোদ সরকারের পিছনে চর লাগিয়েছিলেন?’

না। বিনোদ সরকারের ওপর আমার সন্দেহ হয়নি। তার কোনো মোটিভ ছিল না। সুরেশ্বরকে হয়তো মারতে পারতো‌, কিন্তু হাসিকে মারবে কেন?’

‘তা বটে। দিনমণি হালদার তখন কোথায় ছিল। খোঁজ নিয়েছিলেন?’

নিয়েছিলাম। সে তখন পঞ্চাশ মাইল দূরে একটা গ্রামে ছিল। আমাশায় ভুগছিল। নড়বার ক্ষমতা ছিল না। তাছাড়া ওভাবে খুন করবার কৌশল সে জানবে কোত্থেকে?’

‘হুঁ। আচ্ছা‌, একটা কথা বলুন। আপনার কি মনে হয় হাসির স্বভাব-চরিত্র মন্দ ছিল?’

‘না। আমার বিশ্বাস সে ভাল মেয়ে ছিল।’

ব্যোমকেশ নতমুখে ভাবিতে ভাবিতে বলিল‌, ‘কিন্তু তার রক্তে দোষ ছিল। তার মা-কি নাম হাসির মায়ের?’

‘অমলা।’

ব্যোমকেশ চোখ তুলিয়া নীলমণিবাবুর পানে চাহিল; তিনিও প্রখর চক্ষে তাহার পানে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার শরীর ক্রমশ কঠিন হইয়া উঠিতে লাগিল। কিছুক্ষণ দুইজনের চোখে চোখ আবদ্ধ হইয়া রহিল; তারপর ব্যোমকেশ তাকিয়া ঠেস দিয়া বসিল‌, নিবাপিত গড়গড়ার নলটা হাতে তুলিয়া লইল।

নীলমণিবাবু আত্মসংবরণ করিয়া ধীরস্বরে বলিলেন‌, ‘আর কিছু জানতে চান?’

ব্যোমকেশ নিরুৎসুকভাবে মাথা নাড়িল‌, ‘আর কিছু জানিবার নেই।’

নীলমণিবাবু একটু বাঁকা সুরে বলিলেন‌, ‘কিছু বুঝলেন?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘সবই বুঝেছি‌, নীলমণিবাবু।’

0 Shares