অচিন পাখি

নীলমণিবাবু কিছুক্ষণ স্থির হইয়া রহিলেন‌, শেষে বলিলেন‌, ‘সবই বুঝেছেন! হাসিকে কে খুন করেছিল। আপনি বুঝেছেন?’

‘বুঝেছি বৈকি। হাসিকে খুন করেছিল সুরেশ্বর।’

‘তাই নাকি! তাহলে সুরেশ্বরকে মারল কে?’

‘সুরেশ্বরকে মেরেছিল-হাসির বাপ।’

‘হাসির বাপ! কিন্তু দিনমণি হালদার সে-সময় পঞ্চাশ মাইল দূরে ছিল—’

‘আমি দিনমণি হালদারের কথা বলিনি‌, হাসির বাপের কথা বলেছি। হাসির জন্মদাতা পিতা।’

নীলমণিবাবু নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিলেন। দেখিতে লাগিলাম। তাঁহার মুখ হইতে পরতে পরতে রক্ত নামিয়া যাইতেছে। অবশেষে তিনি যখন কথা বলিলেন তখন তাঁহার কণ্ঠস্বরের গাম্ভীৰ্য আর নাই‌, ক্ষীণ স্বলিত স্বরে বলিলেন‌, ‘জন্মদাতা পিতা-কার কথা বলছেন?’

ব্যোমকেশ দুঃখিতভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল‌, ‘কার কথা বলছি আপনি জানেন‌, নীলমণিবাবু। গল্পটা আমাকে না বললেই ভাল করতেন।’

অতঃপর নীলমণিবাবু কী বলিতেন তাহা আর শোনা হইল না। বীরেনবাবু প্রবেশ করিয়া বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, রান্না তৈরি। আপনারা স্নান করে নিন। নীলমণিদা‌, আপনিও মধ্যাহ্ন ভোজনটা এখানেই সেরে নিন না?’

নীলমণিবাবু ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

‘না না‌, আমি চললাম। অনেক দেরি হয়ে গেল।’ বলিয়া তিনি দ্রুত প্রস্থান করিলেন। আমাদের প্রতি দৃকপাত করিলেন না।

আহারাদি সম্পন্ন করিয়া দুইজনে তাকিয়া মাথায় দিয়া লম্বা হইয়াছিলাম। গড়াগড়া চলিতেছিল।

বলিলাম‌, ‘কি করে বুঝলে বল।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘নীলমণিবাবুর গল্প শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল হাসির প্রতি তাঁর পক্ষপাত আছে। অথচ তাঁর গল্প অনুযায়ী‌, হাসিকে জীবিত অবস্থায় তিনি দেখেননি। তার চরিত্র সম্বন্ধে যে সাক্ষী প্রমাণ পাওয়া যায়‌, তাতে তাকে পতিগতপ্ৰাণা সতীসাধবী মনে করবার কারণ নেই। সে প্রগলভা ছিল‌, তার স্বামী তাকে সন্দেহ করত‌, একজন অজ্ঞাত লোক রাত্রে তার সঙ্গে দেখা করত। তবে তার প্রতি নীলমণিবাবুর পক্ষপাত কেন?

‘হাসির মা অমলাও সীতা-সাবিত্রী ছিল না। অমলার স্বামী দিনমণি হালদার জেলখানার পোষা পাখি হয়ে দাঁড়িয়েছিল; মাঝে মাঝে ছাড়া পেত‌, আবার জেলে গিয়ে ঢুকত। দিনমণি হালদার হাসির বাপ নাও হতে পারে।

‘বিনোদ সরকারও হাসির বাপ নয়। হাসির মায়ের সঙ্গে যখন তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল‌, তখন হাসির বয়স তিন-চার বছর। তবে কে?

‘নীলমণিবাবু গল্প বলবার আগে কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন‌, পুলিসের চাকরিতে ঢুকে প্রথম তিনি এই শহরে পোস্টেড হয়েছিলেন। দিনমণি পেশাদার চোর‌, তাকে ধরতে কিংবা তার ঘর-দোর খানাতল্লাশ করবার জন্যে হয়তো নীলমণিবাবু গিয়েছিলেন। তিনি তখন যুবক‌, হয়তো দিনমণির কুহকময়ী স্ত্রীর ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলেন; দিনমণি জেলে যাবার পর গোপনে দু’জনের মেলামেশা হয়েছিল।

‘দু-তিন বছর পরে নীলমণিবাবু এ জেলা থেকে বদলি হয়ে গেলেন; যাবার আগে জেনে গেলেন তাঁর একটি মেয়ে আছে। মেয়ের নাম হাসি। দূরে গিয়েও তিনি হাসি ও হাসির মায়ের খবর রাখতেন। তিনি বিয়ে করেননি‌, তাই সংসারের বন্ধন হাসিকে ভুলিয়ে দিতে পারেনি। সংসারে হাসিই তাঁর একমাত্র রক্তের বন্ধন।

‘কর্মজীবনের শেষের দিকে তিনি আবার এই শহরে ফিরে এলেন। হাসির মা তখন মরে গেছে‌, হাসির বিয়ে হয়েছে। নীলমণিবাবুর অভ্যাস ছিল তিনি গভীর রাত্রে সাইকেল চড়ে শহর তদারক করতে বেরুলেন। সেই সময় হাসির সঙ্গে দেখা করতেন, তাকে ছোটখাটো দু-একখানা গয়না উপহার দিতেন। হাসিকে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন। কিনা বলা যায় না। তবে হাসি হয়তো আন্দাজ করেছিল।

‘যে-রাত্রে সুরেশ্বর হাসিকে খুন করে সে-রত্রে নীলমণিবাবু হাসির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। তারপর যা-যা হয়েছিল সবই আমরা নীলমণিবাবুর মুখে শুনেছি। আমার বিশ্বাস সুরেশ্বর তাস খেলতে খেলতে উঠে এসে হাসিকে খুন করেছিল‌, তারপর ফিরে গিয়ে বন্ধুদের বলেছিল–বৌকে খুন করেছি‌, এখন তোরা আমাকে বাঁচা। চারজনের মধ্যে অটুট বন্ধুত্র। তারা পরামর্শ করে স্থির করল‌, মড়া পুড়িয়ে ফেলা যাক‌, তারপর রটিয়ে দিলেই হবে‌, হাসি কুলত্যাগ করেছে।

‘নীলমণিবাবু চার বন্ধুকে থানায় ধরে আনলেন‌, কিন্তু তাদের অ্যালিবাই ভাঙতে পারলেন না। তিনি যখন দেখলেন তাঁর মেয়ের হত্যাকারীকে ফাঁসিকাঠে লটকাতে পারবেন না। তখন ঠিক করলেন নিজেই তাঁকে খুন করবেন। তিনি আর বিলম্ব করলেন না‌, হাসির মৃত্যুর চব্বিশ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই সুরেশ্বরকে খুন করলেন।

‘কিন্তু ভেবে দেখ‌, আমি যেভাবে গল্পটাকে খাড়া করেছি‌, তার আগাগোড়াই অনুমান। এই অনুমান কেবল তখনি সত্যে পরিণত হতে পারে যদি নিশ্চয়ভাবে জানা যায় যে‌, নীলমণিবাবু হাসির বাপ! আমি তাঁর জন্যে ফাঁদ পাতলাম‌, আচমকা জিগ্যেস করলাম-হাসির মায়ের নাম কি? তিনি না ভেবেচিন্তে বলে ফেললেন–অমলা!

‘হাসির মায়ের নাম তিনি জানলেন কি করে? দশ বছর আগে সে মরে গেছে‌, এই মামলায় তার নাম একবারও কেউ উচ্চারণ করেনি। তবে নীলমণিবাবু জানলেন কি করে? আর সন্দেহ রইল না।

‘আমার সামনেই হাসির মায়ের নাম উচ্চারণ করেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে‌, অসাবধানে তিনি ফাঁদে পা দিয়েছেন‌, আমিও তাঁর মুখ দেখে বুঝতে পেরেছিলাম আমার ফাঁদ পাতা ব্যর্থ হয়নি। নীলমণিবাবুর অজানা আসামী স্বয়ং নীলমণিবাবু।’

ব্যোমকেশের যুক্তিজালে ছিদ্র পাইলাম না। বলিলাম‌, নীলমণিবাবু তাহলে নিরস্ত্র যুদ্ধের কায়দা আগে থাকতে জানতেন।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘না। বিদ্যেটা তিনি সিভিল সার্জন মেজর বর্মণের কথা শুনে শিখে নিয়েছিলেন।’

(সমাপ্ত)

0 Shares