অদৃশ্য ত্রিকোণ

গল্পটি শুনিয়াছিলাম পুলিস ইন্সপেক্টর রমণীমোহন সান্যালের মুখে। ব্যোমকেশ‌, এবং আমি পশ্চিমের একটি বড় শহরে গিয়াছিলাম গোপনীয় সরকারী কাজে‌, সেখানে রমণীবাবুর সহিত পরিচয় হইয়াছিল। সরকারী কাজে লাল ফিতার জট ছাড়াইতে বিলম্ব হইতেছিল‌, তাই আমরাও নিষ্কমার মত ডাকবাংলোতে বসিয়া ছিলাম। রমণীবাবু প্ৰায় প্রত্যহ সন্ধ্যার পর আমাদের আস্তানায় আসিতেন‌, গল্পসল্প হইত। তাঁহার চেহারাটাও ছিল রমণীমোহন গোছের‌, ভারি মিষ্ট এবং কমনীয়। কিন্তু সেটা তাঁহার ছদ্মবেশ। আসলে তিনি পুলিস বিভাগের একজন অতি চতুর এবং বিচক্ষণ কর্মচারী। তাঁহার বয়স আমাদের চেয়ে কমই ছিল‌, বছর চল্লিশের বেশি নয়। কিন্তু প্রকৃতিগত সমধর্মিতার জন্য তিনি আসিলে আডা বেশ জমিয়া উঠিত।

আমাদের কাছে তাঁর ঘন ঘন যাতায়াত যে নিঃস্বার্থ সহৃদয়তা না হইতে পারে একথা অবশ্যই আমাদের মনে উদয় হইয়াছিল; উদ্দেশ্যটা যথাসময়ে প্রকাশ পাইবে এই আশায় প্রতীক্ষ্ণ করিতেছিলাম।

তারপর একদিন তিনি আমাদের গল্পটি শুনাইলেন। ঠিক গল্প নয়‌, একটি খুনের মামলার কয়েকটি ঘটনার পরম্পরা। কিন্তু এই বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলিকে জোড়া দিয়া একটি সুসংবদ্ধ গল্প খাড়া করা যায়।

বিবৃতি শেষ করিয়া রমণীবাবু বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, কে খুন করেছে আমি জানি‌, কেন খুন করেছে জানি; কিন্তু তবু লোকটাকে ফাঁসি-কাঠে ঝোলাতে পারছি না। প্রমাণ নেই। একমাত্র উপায় কনফেশান‌, আসামীকে নিজের মুখে অপরাধ স্বীকার করানো। আপনার মাথায় অনেক ফন্দি-ফিকির আসে‌, লোকটাকে ফাঁদে ফেলবার একটা মতলব বার করতে পারেন না?

ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল‌, ‘ভেবে দেখব।’

গল্পটি আমাকে আকৃষ্ট করিয়াছিল; বোধ হয় ব্যোমকেশের মনেও রেখাপাত করিয়া থাকিবে। সে-রাত্রে রমণীবাবু প্রস্থান করিবার পর ব্যোমকেশ বলিল‌, রমণীবাবু যে মালমসলা দিয়ে গেলেন তা দিয়ে তুমি একটা গল্প লিখতে পার না?

বলিলাম‌, ‘পারি। মালমসলা ভাল। কেবল চরিত্রগুলির মনস্তত্ত্ব জুড়ে দিতে পারলেই গল্প হবে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তবে লেখ। কিন্তু একটা শর্ত আছে; গল্প জমাবার অছিলায় ঘটনা বদলাতে পারবে না।’

‘বদলাবার দরকার হবে না।’

গল্প লিখিতে দুদিন লাগিল। লেখা শেষ করিয়া ব্যোমকেশকে দিলাম‌, সে পড়িয়া বলিল‌, ‘ঠিকই হয়েছে মনে হচ্ছে। রমণীবাবুকে পড়িয়ে দেখা যাক‌, তিনি কি বলেন।’

রাত্রে রমণীবাবু আসিলে তাঁহাকে গল্প পড়িতে দিলাম। তিনি পড়িয়া উৎফুল্ল চক্ষে আমার পানে চাহিলেন—‘এই তো! ঘটনার সঙ্গে মনস্তত্ত্ব বেমালুম জোড় খেয়ে গেছে। কিন্তু—’

গল্পটি নিম্নে দিলাম–

শিবপ্রসাদ সরকার এই শহরে মদের ব্যবসা করিয়া বড়মানুষ হইয়াছিলেন। টাকার প্রতি তাঁহার যথার্থ অনুরাগ ছিল‌, তাই প্রকাণ্ড বাড়ি‌, দামী মোটর ছাড়াও তিনি প্রচুর টাকা জমা করিয়াছিলেন। লোকে তাঁহাকে কৃপণ বলিত‌, তিনি নিজেকে বলিতেন হিসাবী। এই দুই মনোভাবের মধ্যে সীমারেখা অতিশয় সূক্ষ্ম, আমরা তাহা নির্ধারণ করিবার চেষ্টা করিব না।

কিন্তু প্রকৃতির রাজ্যে একটা ভারসাম্য আছে। শিবপ্রসাদ সরকারের একমাত্র মাতৃহীন পুত্র যখন সাবালক হইয়া উঠিল‌, তখন দেখা গেল তাহার চরিত্র পিতার ঠিক বিপরীত। সে অকৃপণ এবং বেহিসাবী‌, টাকার প্রতি তাহার বিন্দুমাত্র অনুরাগ নাই; কিন্তু টাকার বিনিময়ে যে সকল বৈধ এবং অবৈধ ভোগ্যবস্তু পাওয়া যায় তাহার প্রতি গভীর অনুরাগ আছে। সে দুহাতে টাকা উড়াইতে আরম্ভ করিল।

পিতা শিবপ্রসাদ ধূতরাষ্ট্র ছিলেন না বটে‌, কিন্তু তাঁহার অন্তরে যথেষ্ট অপত্যস্নেহ ছিল। পুত্রের চালচলন লক্ষ্য করিয়া তিনি একটি সুন্দরী কন্যার সহিত তাহার বিবাহ দিলেন। কিন্তু তাহাতে স্থায়ী ফল হইল না। সুনীল কিছুকাল স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত হইয়া রহিল‌, তারপর আবার নিজ মূর্তি ধারণ করল।

বধূর নাম রেবা; সে সুন্দরী হইলেও বুদ্ধিমতী‌, অস্তুত তাহার সংসারবুদ্ধি যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। উপরন্তু সে শিক্ষিতা এবং কালধৰ্মে আধুনিকাও বটে। সে স্বামীর স্বৈরাচার অগ্রাহ্য করিয়া একান্তমনে বৃদ্ধ শ্বশুরের সেবায় নিযুক্ত হইল। শিবপ্রসাদ বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত নিজেই ব্যবসাঘটিত কাজ-কর্ম দেখিতেন; কারণ পুত্র অপদাৰ্থ এবং কর্মচারীদের শিবপ্রসাদ বিশ্বাস করিতেন না। রেবা তাঁহার অধিকাংশ কাজের ভার নিজের হাতে তুলিয়া লইল। মোটর চালাইয়া শ্বশুরকে কর্মস্থলে লইয়া যাইত, সেখানে নানাভাবে তাঁহাকে সাহায্য করিত, তারপর মোটর চালাইয়া তাঁহাকে গৃহে ফিরাইয়া আনিত। এইভাবে রেবা শিবপ্রসাদের পুত্রের স্থান অধিকার করিয়া লইয়াছিল।

তারপর‌, রেবা ও সুনীলের বিবাহের চার বছর পরে শিবপ্রসাদের মৃত্যু হইল। তাঁহার মৃত্যুর পর প্রকাশ পাইল তিনি সমস্ত সম্পত্তি পুত্রবধূর নামে উইল করিয়া গিয়াছেন।

সম্পত্তি হাতে পাইয়া রেবা প্রথমেই মদের দোকানের বারো আনা অংশ বিক্রয় করিয়া দিল‌, চার আনা হাতে রাখিল। বড় বাড়িটা বিক্রয় করিয়া শহরের নির্জন প্রান্তে একটি সুদৃশ্য ছোট বাড়ি কিনিল‌, বড় মোটর বদল করিয়া একটি ছোট্ট ফিয়েট গাড়ি লইল। স্বামীকে বলিল‌, ‘তুমি মাসে তিনশো টাকা হাত-খরচ পাবে। যদি বাজারে ধার করে তার জন্য আমি দায়ী হব না। খবরের কাগজে ইস্তাহার ছাপিয়ে দিয়েছি।’

তারপর তাহারা ছোট বাড়িতে উঠিয়া গিয়া বাস করিতে লাগিল। তাহদের সন্তান-সন্ততি জন্মে নাই।

এই গেল গল্পের ভূমিকা।

0 Shares