সুনীলের বয়স আন্দাজ ত্রিশ বছর, আঁটসাঁট মোটা শরীর, গোল মুখখানা প্যাঁচার মুখের মত থ্যাবড়া, মুখ দেখিয়া মনে হয় না বুদ্ধিসুদ্ধি কিছু আছে। বস্তুত যাহারা বাপের পয়সা উড়াইয়া ফুর্তি করে, তাহাদের বুদ্ধির চেয়ে প্রবৃত্তিরই জোর বেশি, ইহা একপ্রকার স্বতঃসিদ্ধ, প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। সুনীলকেও সকলে অমিতাচারী অপরিণামদর্শী নির্বোধ বলিয়া জানিত।
সুনীল কিন্তু নির্বোধ ছিল না। সদবুদ্ধি না থাক, দুষ্টবুদ্ধি তাহার যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। পিতার মৃত্যুর পর সে যখন দেখিল সম্পত্তি বেহাত হইয়া গিয়াছে তখন সে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করিল না, টাকার জন্য হিন্বিতম্বি করিল না, কেমন যেন জবুথবু হইয়া গেল। শিবপ্রসাদ যতদিন জীবিত ছিলেন সুনীলের বাজার-দেনা তিনিই শোধ করিতেন। কিন্তু রেবা খবরের কাগজে ইস্তাহার ছাপিয়া দিয়াছে, এখন বাজারে কেহ তাহাকে ধার দিবে না। দৈনিক দশ টাকায় কত ফুর্তি করা যায়? সুতরাং সুনীল সুবোধ বালকের ন্যায়। ঘরেই দিন যাপন করিতে লাগিল। হপ্তায় একদিন কি দুইদিন বৈকালে বাহির হইত, বাকি দিনগুলি বাড়িতে রোমাঞ্চকর বিলাতি উপন্যাস পড়িয়া কাটাইত। রেবার সহিত তাহার সম্পর্কটা নিতান্তাই ব্যবহারিক সম্পর্ক হইয়া দাঁড়াইল; বাহ্যত এক বাড়িতে থাকার ঘনিষ্ঠতা, অন্তরে দুর্লঙ্ঘ্য দূরত্র। তাঁহাদের শয়নের ব্যবস্থাও পৃথক ঘরে।
রেবা সকালবেলা মোটর চালাইয়া বাহির হয়; মদের ব্যবসায় সে চার-আনা অংশীদার, প্রত্যহ নিজে হিসোব পরীক্ষা করে; সেখান হইতে দুপুরবেলা ফিরিয়া আসে। অপরাহ্নে আবার বাহির হয়। এবার কিন্তু ব্যবসা নয়; মেয়েদের একটা ক্ষুদ্র ক্লাব আছে, সেখানে গিয়া গল্পগুজব খেলাধূলা করে, কখনও সিনেমা দেখিতে যায়; তারপর গৃহে ফিরিয়া আসে। সুনীল সারাক্ষণ বাড়িতেই থাকে।
একটা বুড়ি গোছের ঝি আছে, তাহার নাম আন্না; বাড়ির কাজ, রান্নাবান্না সব সে-ই করে, অন্য চাকর নাই। রেবা সব দিক দিয়া খরচ কমাইয়াছে।
একদিন সন্ধ্যার পর সুনীল বসিবার ঘরে রহস্য উপন্যাস পড়িতেছিল, রাত্রি আর্টর সময় রেবা ফিরিয়া আসিল। গাড়ি গ্যারাজে বন্ধ করিয়া বেশবাস পরিবর্তন করিয়া একখানা বাংলা বই হাতে লইয়া বসিবার ঘরে একটি সোফায় আসিয়া বসিল। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কোনও কথা হইল না। নৈশ আহারের বিলম্ব আছে; রেবা বই খুলিয়া পড়িতে আরম্ভ করিল। বইখানার নাম-ব্যোমকেশের কাহিনী।
সুনীলের ভোঁতা মুখ ভাবলেশহীন। সে একবার চোখ তুলিয়া রেবার পানে চাহিল, আবার পুস্তকে চক্ষু ন্যস্ত করিল, তারপর একটু গলা খাঁকারি দিল।
‘রেবা—‘
রেবা ভ্রূ তুলিয়া চাহিল। সুনীল ইতস্তত করিয়া বলিল, ‘তুমি কোন দিন বাড়ির সামনে একটা লোককে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছি?’
রেবা বই মুড়িয়া কিছুক্ষণ সুনীলের পানে চাহিয়া রহিল, শেষে বলিল, ‘না। কেন?’
সুনীল ধীরে ধীরে বলিল, ‘কয়েকদিন থেকে লক্ষ্য করছি, সন্ধ্যের পর একটা লোক বাড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে রাস্তা দিয়ে যায়, আবার খানিক পরে তাকাতে তাকাতে ফিরে যায়।’
রেবা কিয়ৎকাল চিন্তা করিয়া বলিল, ‘কি রকম চেহারা লোকটার?’
সুনীল বলিল, ‘গুণ্ডার মত চেহারা। কালো মুর্কে জোয়ান, মাথায় পাগড়ি।’
অনেকক্ষণ আর কথা হইল না; তারপর রেবা মনস্থির করিয়া বলিল, ‘কাল সকালে তুমি থানায় গিয়ে এত্তেলা দিয়ে এস। নির্জন জায়গা, যদি সত্যিই চোর-ছাঁচড় হয় পুলিসকে জানিয়ে রাখা ভাল।
সুনীল কিছুক্ষণ থতমত হইয়া রহিল, শেষে সঙ্কুচিত স্বরে বলিল, ‘তুমি বাড়ির মালিক, তুমি পুল্লিসে খবর দিলেই ভাল হত না?
রেবা বলিল, কিন্তু আমি তো মুস্কো জোয়ান লোকটাকে দেখিনি।–তা না হয় দু’জনেই যাব।’
পরদিন সকালে তাহারা থানায় গেল; নিজেদের এলাকার ছোট থানায় না গিয়া একেবারে সদর থানায় উপস্থিত হইল। সেখানে বড় দারোগা রমণীবাবু বাঙালী, তাঁহার সহিত সামান্য জানাশোনা আছে।
রমণীবাবু তাঁহাদের খাতির করিয়া বসাইলেন। সুনীলের বাক্যালাপের ভঙ্গীটা একটু মন্থর ও এলোমেলো, তাই রেবাই ঘটনা বিবৃত করিল। এত্তেলা লিখিত হইবার পর রমণীবাবু বলিলেন, ‘আপনাদের বাড়িটা একেবারে শহরের এক টেরে। যাহোক, ভয় পাবেন না। আমি ব্যবস্থা করছি, রাত্রে টহলদার পাহারাওলা বাড়ির ওপর নজর রাখবে।’
থানা হইতে রেবা কাজে চলিয়া গেল, সুনীল পদব্রজে বাড়ি ফিরিয়া আসিল।
সেদিন বৈকালে রেবা বলিল, ‘এ-বেলা আমি বেরুব না, শরীরটা তেমন ভাল ঠেকছে না।’
সুনীল বই ফেলিয়া উঠিয়া পড়িল, বলিল, ‘তাহলে আমি একটু ঘুরে আসি।
রেবার মুখে অসন্তোষ ফুটিয়া উঠিল, ‘তুমি বেরুবে। কিন্তু দেরি কোরো না বেশি, সকাল সকাল ফিরে এস; না হয় গাড়িটা নিয়ে যাও—’
সুনীল বলিল, দরকার নেই, হেঁটেই যাব। মাঝে মাঝে হাঁটলে শরীর ভাল থাকে।’
উৎকণ্ঠার মধ্যেও রেবার মন একটু প্রসন্ন হইল। নিজের ছোট্ট গাড়িখানাকে সে ভালবাসে, নিজের হাতে তাহার পরিচর্যা করে; সুনীলের হাতে গাড়ি ছাড়িয়া দিতে তাহার মন সরে না।
সুনীল গায়ে একটা ধূসর রঙের শাল জড়াইয়া লইয়া বাহির হইয়া গেল। শীতের আরম্ভ্্, পাঁচটা বাজিতে না বাজিতে সন্ধ্যা হইয়া যায়।
সুনীল শহরের কেন্দ্বস্থিত গলিযুঁজির মধ্যে যখন পৌঁছিল তখন ঘোর-ঘোর হইয়া আসিয়াছে। সে একটা জীর্ণ বাড়ির দরজায় টোকা মারিল; একজন মুস্কো জোয়ান লোক বাহির হইয়া আসিল। সুনীল খাটো গলায় বলিল, ‘হুকুম সিং, তোমাকে দরকার আছে।’
হুকুম সিং সেলাম করিল। মুকুন্দ সিং এবং হুকুম সিং দুই ভাই শহরের নামকরা পালোয়ান ও গুণ্ডা; সুনীলের সঙ্গে তাঁহাদের অনেক দিনের পরিচয়। বড় মানুষের উচ্ছৃঙ্খল ছেলে এবং গুণ্ডাদের মধ্যে এমন একটি আত্মিক যোগ আছে যে, আপনা হইতেই হৃদ্যতা জমিয়া ওঠে।