অদৃশ্য ত্রিকোণ

সুনীল দ্রুত-হ্রস্ব কণ্ঠে হুকুম সিংকে কিছু উপদেশ দিল‌, তারপর তাহার হাতে কয়েকটা নোট গুজিয়া দিয়া তাড়াতাড়ি গলি হইতে বাহির হইয়া গেল। সন্ধ্যার আবছায়া আলোতে ধূসর শাল গায়ে লোকটিকে কেহ লক্ষ্য করিল না; লক্ষ্য করলেও সুনীল সরকার বলিয়া চিনিতে পারিত না। এই বস্তিতে সুনীলকে চিনিবে এমন লোক কটাই বা আছে!

সুনীল বাড়ি ফিরিতেই রেবা বলিল‌, ‘এলে? এত দেরি হল যে!’ সুনীল ফিরিয়া আসায় সে মনে স্বস্তি পাইয়াছে তাহা বেশ বোঝা যায়। রেবার মনে সুনীলের প্রতি তিলমাত্র স্নেহ নাই‌, স্বামীকে ভালবাসিতেই হইবে এরূপ সংস্কারও নাই; তাহার হৃদয় এখন সম্পূর্ণ স্বায়ত্ত ও স্বাধীন। কিন্তু মেয়েমানুষ যতাই স্বাধীন হোক‌, পুরুষের বাহুবলের ভরসা তাহারা ছাড়িতে পারে না।

সুনীল ঘড়ি দেখিয়া বলিল‌, ‘এখনো এক ঘণ্টা হয়নি। খানিকটা ঘুরে বেড়িয়েছি বৈ তো নয়।

আর কোনও কথা হইল না। চা পান করিয়া দু’জনে বই লইয়া বসিল।

রেবা কিন্তু স্থির হইতে পারিল না। সদর দরজা বন্ধ ছিল‌, সে মাঝে মাঝে উঠিয়া গিয়া জানোলা দিয়া রাস্তার দিকে উঁকি মারিতে লাগিল। রাস্তাটা শহরের দিক হইতে আসিয়া রেবার বাড়ি অতিক্রম করিয়া কিছুদূর যাইবার পর মোঠ-ময়দান ও ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে অদৃশ্য হইয়াছে। রাস্তার শেষ দীপস্তম্ভটা বাড়ির প্রায় সামনাসামনি দাঁড়াইয়া ত্ৰিয়মাণ আলো বিতরণ করিতেছে।

একবার জানালায় উঁকি মারিয়া আসিয়া রেবা সোফায় বসিল‌, হাতের বইখানা খুলিয়া তাহার পানে চাহিয়া রহিল; তারপর যেন নিরাসক্ত কৌতুহলবশেই প্রশ্ন করিল‌, ‘পুলিসের টহলদার রাত্রে কখন রোঁদ দিতে বেরোয়?’

সুনীল বই হইতে বোকাটে মুখ তুলিয়া খানিকক্ষণ চাহিয়া রহিল‌, শেষে বলিল‌, ‘তা তো জানি না। রাত্রি দশটা এগারোটা হবে বোধ হয়।’

রেবা বিরক্তিসূচক মুখভঙ্গী করিল‌, আর কিছু বলিল না। দু’জনে নিজ নিজ পাঠে মন দিল। রাত্রি ঠিক আটটার সময় রেবা চমকিয়া মুখ তুলিল। রাস্ত হইতে যেন একটা শব্দ আসিল। রেবা উঠিয়া গিয়া আবার জানালার পদ সরাইয়া উঁকি মারিল। শহরের দিক হইতে একটা লোক আসিতেছে। রাস্তার নিস্তেজ আলোয় তাহাকে অস্পষ্ট দেখা গেল; গাঁটা-গোঁট্টা চেহারা‌, মাথায় বৃহৎ পাগড়ি মুখের উপর ছায়া ফেলিয়াছে‌, হাতে লম্বা লাঠি। লোকটা বাড়ির দিকে ঘাড় ফিরাইয়া চাহিতে চাহিতে চলিয়া গেল।

রেবা সশব্দে নিশ্বাস টানিল। সুনীল সেই দিকে ফিরিয়া দেখিল রেবার মুখ পাংশু হইয়া গিয়াছে; সে নীরবে হাতছানি দিয়া তাহাকে ডাকিতেছে। সুনীল উঠিয়া গিয়া রেবার পাশে দাঁড়াইল

রেবা ফিসফিস করিয়া বলিল‌, ‘বোধ হয়। সেই লোকটা‌, তুমি যাকে দেখেছিলে।’

সুনীল ঘাড় নাড়িল। দু’জনে পাশাপাশি জানালার কাছে দাঁড়াইয়া রহিল। কিছুক্ষণ পরে আবার নাগরা জুতার আওয়াজ শোনা গেল; লোকটা ফিরিয়া আসিতেছে। রেবা নিশ্বাস রোধ করিয়া রহিল।

লোকটা বাড়ির পানে চাহিতে চাহিতে শহরের দিকে ফিরিয়া গেল। তাহার পদধ্বনি মিলাইয়া যাইবার পর রেবা প্রশ্ন-বিস্ফারিত চক্ষে সুনীলের পানে চাহিল। সুনীলের মনে নিগূঢ় সন্তোষ‌, কিন্তু সে মুখে দ্বিধার ভাব আনিয়া বলিল‌, ‘সেই লোকটাই মনে হচ্ছে।’

দু’জনে ফিরিয়া আসিয়া বসিল। রেবার মুখ শঙ্কাব্বিশীৰ্ণ হইয়া রহিল। সুনীল তাহার প্রতি একটা চোরা কটাক্ষ হানিয়া বই খুলিল।

ঝি আসিয়া প্রশ্ন করিল-খাবার দিবে কি না। অতঃপর দু’জনে খাইতে গেল।

আহার করিতে করিতে সুনীল বলিল‌, ‘বোধ হয় ভয়ের কিছু নেই। পুলিস যখন দেখাশোনা করবে বলেছে—’

প্রত্যুত্তরে রেবার অন্তরের উষ্মা ঝন ঝন শব্দে বাহির হইয়া আসিল‌, ‘পুলিস তো আর সারা রাত্রি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পাহারা দেবে না‌, মাঝে মাঝে টহল দিয়ে যাবে। তার ফাঁকে যদি পাঁচটা ডাকাত দোর ভেঙে বাড়িতে ঢোকে‌, তখন কি করব?’

সুনীল মুখ হেঁট করিয়া আহার করিতে লাগিল, শেষ বলিল, ‘বাড়িতে লাঠি-সোঁটা কিছু আছে?’

রেবা গভীর বিরক্তিভরে স্বামীর পানে একবার চাহিল‌, এই বালকোচিত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া প্রয়োজন বোধ করিল না। লাঠি-সোঁটা থাকিলেও চালাইবে কে?

রাত্রে রেবা নিজ শয়নকক্ষের দ্বারে উপরে-নীচে ছিটুকিনি লোগাইয়া শয়ন করিল। এত সতর্কতার অবশ্য প্রয়োজন ছিল না‌, রমণীবাবু তাহার বাড়ি পাহারার ভাল ব্যবস্থাই করিয়াছিলেন। কিন্তু রেবার মনের অশান্তি দূর হইল না; বিছানায় শুইয়া সে অনেকক্ষণ জাগিয়া রহিল।

শহরের একান্তে বাড়িটা না কিনিলেই হইত…কিন্তু তখন কে জানিত? এখন চোর-ছাঁচড়ের ভয়ে বাড়ি ছাড়িয়া গেলে মান থাকিবে না…স্বামী বিষয়বুদ্ধিহীন অপদাৰ্থ…কি করা যায়? দুটো শক্ত-সমর্থ গোছের চাকর রাখিবে? কিন্তু চাকরের উপর ভরসা কি? যে রক্ষক সেই ভক্ষক হইয়া উঠিতে পারে। ডাকাতেরা ঘুষ খাওয়াইয়া যদি চাকরদের বশ করে‌, তাহারাই রাত্রে দ্বার খুলিয়া ডাকাতদের ঘরে ডাকিয়া আনিবে…তার চেয়ে বুড়ি আন্না ভাল…শয়নঘরের লোহার সিন্দুকে দামী গহনা আছে‌, কিন্তু আত্মরক্ষার একটা অস্ত্র নাই।…

হঠাৎ একটা কথা মনে হওয়ায় রেবা উত্তেজিতভাবে বিছানায় উঠিয়া বসিল।

তাহার শ্বশুরের একটা পিস্তল ছিল। ছয় মাস পূর্বে তিনি যখন মারা যান‌, তখন পিস্তলটা থানায় জমা দেওয়া হইয়াছিল। সেই পিস্তলটিা কি ফেরত পাওয়া যায় না? কাল সকালেই সে থানায় গিয়া রমণীবাবুর সঙ্গে দেখা করিবে। একটা পিস্তল বাড়িতে থাকিলে আর ভয় কি?

অনেকটা নিশ্চিন্ত হইয়া রেবা ঘুমাইয়া পড়িল।

পরদিন সকালে রেবা সুনীলকে লইয়া আবার থানায় চলিল। পথে সুনীলের অনুচ্চারিত প্রশ্নের উত্তরে রেবা বলিল‌, ‘বাবার পিস্তলটি থানায় জমা আছে‌, সেটা ফেরত নিলে ভাল হয় না?’ যেন কথাটা সুনীলের মাথায় আসে নাই‌, এমনিভাবে চোখ বড় করিয়া সে কিছুক্ষণ চিন্তা করিল‌, তারপর ঘাড় নাড়িতে নাড়িতে বলিল‌, ‘ভাল হবে।’

0 Shares