থানায় রমণীবাবু প্রস্তাব শুনিয়া বলিলেন, ‘বেশ তো, একটা দরখাস্ত করে দিন, হয়ে যাবে। কার নামে লাইসেন্স নেবেন?’
এ কথাটা রেবা চিন্তা করে নাই। সে স্ত্রীলোক, পূর্বে কখনও পিস্তল ছেড়ে নাই; আগ্নেয়াস্ত্র সম্বন্ধে তাহার মনে একটা সন্ত্রস্ত শঙ্কার ভাব আছে। কিন্তু সে তাহা প্রকাশ করিতে চায় না, চট্ করিয়া বলিল, ‘কেন, এঁর নামে।’
রমণীবাবু বলিলেন, ‘তাই হবে। আপনি এখনি দরখাস্ত করে দিন; আমি একবার আপনাদের বাড়িতে গিয়ে নিয়ম-রক্ষা রকমের তদারক করে আসব। কালই পিস্তল পেয়ে যাবেন।’
রেবা দরখাস্ত লিখিল, সুনীল তাহাতে সহি করিল। রমণীবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘সুনীলবাবু্, আপনি আগে কখনো বন্দুক-পিস্তল খুঁড়েছেন?’
সুনীল আমতা আমতা ভাবে বলিল, ‘এঁ-না-হ্যাঁ—অনেক দিন আগে লুকিয়ে বাবার পিস্তল নিয়ে কয়েকবার ছুঁড়েছিলাম–তখন ছেলেমানুষ ছিলাম-এঁ-
রমণীবাবু হাসিয়া বলিলেন, ‘কাজটা বে-আইনী হয়েছিল। যার নামে লাইসেন্স সে ছাড়া আর কারুর আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করার হুকুম নেই। অবশ্য আতুরে নিয়মো নাস্তি্্, বিপদে পড়লে সকলেই সব রকম অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে।’
সেদিন বৈকালে রমণীবাবু এনকোয়ারি করিতে আসিলেন এবং চা-জলখাবার খাইয়া ঘণ্টাখানেক গল্প করিয়া প্রস্থান করিলেন। তাঁহার ধারণা জন্মিল সুনীল হাবাগোবা জড়-প্রকৃতির লোক, রেবা তাহাকে নাকে দড়ি দিয়া ঘুরাইতেছে। হাবাগোবা লোকেরা হাতে টাকা পাইলে উচ্ছঙ্খল হয়, সুনীলও তাঁহাই হইয়াছিল, এখন শুধরাইয়া গিয়াছে। সুনীলের প্রকৃত স্বরূপ তিনি তখনও চেনেন নাই।
পরদিন সুনীল গিয়া থানা হইতে লাইসেন্স ও পিস্তল লইয়া আসিল। বন্দুকের দোকান হইতে এক বাক্স কার্তুজও কিনিয়া আনিল।
দুপুরবেলা রেবা বাড়ি ফিরিলে সুনীল পিস্তল ও কার্তুজের বাক্স তাহার সামনে টেবিলের উপর রাখিয়া বলিল, ‘এই নাও।’
রেবা সশঙ্ক চক্ষে আগ্নেয়ন্ত্র নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, ‘আমি কি করব? তুমি রাখো, দরকার হলে তুমিই তো ব্যবহার করবে।’
সুনীল ইহাই প্রত্যাশা করিয়াছিল, সে পিস্তল ও কার্তুজ লইয়া নিজের ঘরে রাখিয়া আসিল।
ইহার দুইদিন পরে পাগড়িধারী দুৰ্বত্তটাকে আর একবার রাস্তা দিয়া যাইতে দেখা গেল। তারপর তাহার যাতায়াত বন্ধ হইল।
এক হপ্তা নিরুপদ্রবে, কাটিয়া যাইবার পর রেবা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘ওরা বোধ হয় জানতে পেরেছে বাড়িতে বন্দুক আছে, তাই আশা ছেড়ে দিয়েছে।’
সুনীল বিজ্ঞের মত মাথাটি নাড়িতে নাড়িতে বলিল, ‘হুঁ।’
তারপর যত দিন কাটিতে লাগিল, রেবার মন ততাই নিরুদ্বেগ হইতে লাগিল। সংসারে স্বাভাবিক অবস্থা আবার ফিরিয়া আসিল। রেবা সকালে কাজে বাহির হয়, বিকালে বেড়াইতে যায়। সুনীল বাড়িতে বসিয়া রহস্য-রোমাঞ্চ পড়ে; কদাচিৎ সন্ধ্যার সময় ঘণ্টাখানেকের জন্য বাড়ি হইতে বাহির হয়। তাহার বন্ধুবান্ধব নাই; সে কখনও রেলওয়ে স্টেশনে গিয়া বইয়ের স্টল হইতে বই কেনে; কখনও শহরের এঁদোপড়া গলিতে হুকুম সিং-এর সঙ্গে দেখা করে। হুকুম সিং-এর সঙ্গে তাহার কাজ এখনও শেষ হয় নাই।
এইভাবে দুই মাস কাটিয়া গেল, শীত শেষ হইয়া আসিল। রেবার মন হইতে গুণ্ডার সম্ভাবিত আক্রমণের কথা সম্পূর্ণ মুছিয়া গেল।
একদিন সন্ধ্যাকালে রেবার দু’টি বান্ধবী বাড়িতে আসিয়াছিল; রেবা তাহাদের লইয়া খাওয়াদাওয়া হাসিগল্পে ব্যস্ত ছিল। রেবার বান্ধবীরা বাড়িতে আসিলে সুনীলকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিয়া চলে, চাকরের মর্যাদাও সে তাঁহাদের কাছে পায় না। তাই তাহারা কেহ আসিলে সুনীল নিজের ঘরে বসিয়া থাকে কিংবা বেড়াইতে যায়। আজও সে নিজের ঘরে চলিয়া গেল, তারপর চুপি চুপি পিছনের দরজা দিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইল। অনেক দিন হইতে সে এই সুযোগের প্রতীক্ষা করিতেছিল।
সুনীল শহরে গিয়া গলির মধ্যে হুকুম সিং-এর সঙ্গে দেখা করিল। দশ মিনিট ধরিয়া হুকুম সিং তাহার নির্দেশ শুনিয়া শেষে বলিল, ‘খবর পেয়েছি বাড়িতে পিস্তল আছে।’
সুনীল পকেট হইতে পিস্তল বাহির করিয়া দেখাইল, পিস্তল খুলিয়া দেখাইল, তাহার মধ্যে টোটা নাই। বলিল, ‘তুমি নিৰ্ভয়ে বাড়িতে ঢুকতে পার।’
হুকুম সিং হাত পাতিয়া বলিল, ‘আমার ইনাম?’
সুনীল দুই মাসে ছয়শত টাকা জমাইয়াছিল। তাঁহাই হুকুম সিং-এর হাতে দিয়া বলিল, ‘এই নাও। এর বেশি এখন আমার কাছে নেই। তুমি কাজ সেরে ওর গায়ের গয়নাগুলো নিও। তারপর সম্পত্তি যখন আমার হাতে আসবে তুমি দশ হাজার টাকা পাবে। আমি এখন রেলওয়ে স্টেশনে যাচ্ছি, রাত্রি আটটার পর বাড়ি ফিরব।’
হুকুম সিং বলিল, ‘বহুৎ খুব।’
‘যা যা বলেছি মনে থাকবে?’
‘জি। আপনি বে-ফিকির থাকুন, আমি সাজসজ্জা করে এখুনি বেরুচ্ছি।’
হুকুম সিং কালিকুলি মাখিয়া ছদ্মবেশ ধারণের জন্য নিজের কোটরে প্রবেশ করিল। সুনীল স্টেশনে গেল না, দ্রুতপদে গৃহের পানে ফিরিয়া চলিল।
অন্ধকার হইয়া গিয়াছে। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছিয়া সুনীল দেখিল বান্ধবীরা এখনও আছে। সে আশ্বস্ত হইয়া রাস্তার ধারে একটা বড় গাছের পিছনে লুকাইয়া রহিল। সেখানে দাঁড়াইয়া সুইতে পিস্তল বাহির কলি অন্য পকেট কার্টুন ছিল, তাহা পিস্তল ভরিয়া প্রস্তুত হইয়া রহিল।
কিছুক্ষণ পরে রেবার বান্ধবীর চলিয়া গেল। রেবা ভিতর হইতে সদর দরজা বন্ধ করিয়া দিল।
রাত্রি সাড়ে সাতটা। রেবা আন্নাকে ডাকিয়া প্রশ্ন করিল, ‘বাবু কোথায় রে?’
আন্না বলিল, ‘বাবু বেরিয়েছে। সদর দিয়ে তোমার ওনারা এলেন, বাবু খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে গেল।’