‘ও। আচ্ছা, তুই রান্না চড়াগে যা।’
রেবা উদ্বিগ্ন হইল না। চোর-ডাকাতের ভয় আর তাহার নাই। সে অন্য কথা ভাবিয়া পরিতৃপ্তির নিশ্বাস ফেলিল। এইভাবে যদি জীবন চলিতে থাকে, মন্দ কি?
বাহিরে গাছের আড়ালে সুনীল ওৎ পাতিয়া বসিয়া আছে। শহরের দিক হইতে হুকুম সিংকে আসিতে দেখা গেল। সে নিঃশব্দে আসিতেছে, নাগরা জুতার আওয়াজ নাই।
দ্বারের সামনাসামনি আসিয়া সে আগে পিছে তাকাইল, তারপর দ্বারে মৃদু টোকা দিল।
সুনীল আসিয়াছে মনে করিয়া রেবা দ্বার খুলিয়া দিল। সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করিয়া হুকুম সিং ভিতর ঢুকিয়া পড়িল এবং দুহাতে রেবার গলা টিপিয়া ধরিল।
একটি অধোচ্চারিত চীৎকার রেবার কণ্ঠ হইতে বাহির হইল, তারপর আর শব্দ নাই। আন্না রান্নাঘর হইতে চীৎকার শুনিতে পাইয়াছিল, সবিস্ময়ে বাহিরের ঘরে উঁকি মারিয়া দেখিল যখের মত কালো দুদন্তি একটা লোক রেবার গলা টিপিতেছে। আন্না বাঙ্নিস্পত্তি করিল না, রান্নাঘরে ফিরিয়া গিয়া দ্বারে হুড়কা আঁটিয়া দিল।
হুকুম সিং যখন দেখিল রেবার দেহে প্ৰাণ নাই তখন সে তাহাকে মেঝোয় শোয়াইয়া দিল; রেবার হাতের কানের গলার গহনাগুলা খুলিয়া লইয়া নিজের পকেটে রাখিল, তারপর সদর দরজা দিয়া বাহির হইল।
গাছের আড়ালে সুনীল এই মুহুর্তটির প্রতীক্ষ্ণ করিতেছিল। ‘কে? কে? বলিয়া সে ছুটিয়া বাহির হইয়া আসিল। হুকুম সিং হতভম্ব হইয়া দাঁড়াইয়া পড়িয়ছিল, সুনীল ছুটিয়া আসিয়া পিস্তল তুলিল, হুকুম সিং-এর বুক লক্ষ্য করিয়া পিস্তলের সমস্ত কার্তুজ উজাড় করিয়া দিল। হুকুম সিং মুখ থুবড়াইয়া সেইখানেই পড়িল, আর নড়িল না।
সুনীল তখন চীৎকার করিতে করিতে গৃহে প্রবেশ করিল–’কী হয়েছে! অ্যাঁ-রেবা-?
রান্নাঘরে আন্না সুনীলের কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইয়া কাঁপিতে কাঁপিতে বাহির হইয়া আসিল। সুনীল ব্যাকুলস্বরে বলিল, ‘আন্না, এ কী হল! রেবা মরে গেছে। গুণ্ডাটা রেবাকে মেরে ফেলেছে। কিন্তু আমিও গুণ্ডাকে মেরেছি!’ সে লাফাইয়া উঠিল—‘পুলিস! আমি পুলিসে খবর দিতে যাচ্ছি।’ বলিয়া ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল।
যথাসময়ে স্থানীয় থানা হইতে পুলিস আসিল। আন্না যাহা দেখিয়াছিল পুলিসকে বলিল।
খবর পাইয়া রমণীবাবু আসিলেন। সুনীল হাব্লার মত তাঁহার পানে চাহিয়া বলিল, ‘আমি বেড়াতে বেরিয়েছিলাম, ফিরে এসে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছুঁতেই একটা চীৎকার শুনতে পেলাম। ছুটে এসে দেখি ওই লোকটা বাড়ি থেকে বেরুচ্ছে। আমার মাথা গোলমাল হয়ে গেল। আমি পিস্তল দিয়ে ওকে মেরেছি। তারপর ঘরে ঢুকে দেখি—’ তাহার ব্যায়ত চক্ষু রেবার মৃতদেহের দিকে ফিরিল; সে দুহাতে মুখ ঢাকিল।
রমণীবাবু ক্ষণেক নীরব থাকিয়া প্রশ্ন করিলেন, ‘আপনি পিস্তল নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন?’
সুন্টুসুমখুলি, ঘাড় নাড়িয়া বলি, ‘হ্যাঁ। আমার নামে পিস্তল, আমি সর্বদা পিস্তল আমার কাছে রাখি।’
রমণীবাবু বলিলেন, ‘পিস্তল দিন। ওটা আমি বাজেয়াপ্ত করলাম।’
সুনীল বিনা আপত্তিতে পিস্তল রমণীবাবু হাতে সমর্পণ করিল। পিস্তলে আর তাহার প্রয়োজন ছিল না।
২
ব্যোমকেশ বলিল, ‘সুনীল সরকার বোকা বটে, কিন্তু বুদ্ধি আছে।’
রমণীবাবু করুণ হাসিয়া বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু্, আমার ধারণা ছিল আমি বুদ্ধিমান, কিন্তু সুনীল সরকার আমাকে বোকা বানিয়ে দিয়েছে। তার মতলব কিছু বুঝতে পারিনি। হুকুম সিংকে খুন করার অপরাধে তাকে যে ধরব সে উপায় নেই। স্পষ্টতই হুকুম সিং তার বাড়িতে ঢুকে তার স্ত্রীকে খুন করে গায়ের গয়না কেড়ে নিয়েছিল, সুতরাং তাকে খুন করার অধিকার সুনীলের ছিল। সে এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছে; পৈতৃক সম্পত্তি উদ্ধার করেছে এবং নিজের দুস্কৃতির একমাত্র শরিককে সরিয়েছে! স্ত্রীর মৃত্যুর পর সে-ই এখন সম্পত্তির উত্তরাধিকারী, কারণ সেই নিকটতম আত্মীয়। রেবার উইল ছিল না, সুনীল আদালতের হুকুম নিয়ে গদীয়ান হয়ে বসেছে।’
‘হঁ’ বলিয়া ব্যোমকেশ চিন্তাচ্ছন্ন হইয়া পড়িল।
রমণীবাবু বলিলেন, ‘একটা রাস্তা বার করুন, ব্যোমকেশবাবু। যখন ভাবি একজন অতি বড় শয়তান আইনকে কলা দেখিয়ে চিরজীবন মজা লুটবে তখন অসহ্য মনে হয়।’
ব্যোমকেশ মুখ তুলিয়া বলিল, ‘রেবা অজিতের লেখা বইগুলো ভালবাসতো?’
রমণীবাবু বলিলেন, ‘হ্যাঁ, ব্যোমকেশবাবু। ওদের বাড়ি আমি আগাপাস্তলা সার্চ করেছিলাম; আমার কাজে লাগে এমন তথ্য কিছু পাইনি, কিন্তু দেখলাম অজিতবাবুর লেখা আপনার কীর্তিকাহিনী সবগুলিই আছে, সবগুলিতে রেবার নাম লেখা। তা থেকে মনে হয়। রেবা আপনার গল্প পড়তে ভালবাসতো।’
ব্যোমকেশ আবার চিন্তামগ্ন হইয়া পড়িল। আমরা সিগারেট ধরাইয়া অপেক্ষা করিয়া রহিলাম। দেখা যাক ব্যোমকেশের মস্তিষ্ক-রূপ গন্ধমাদন হইতে কোন্ বিশল্যকরণী দাবাই বাহির হয়।
দশ মিনিট পরে ব্যোমকেশ নড়িয়া-চড়িয়া বসিল। আমরা সাগ্রহে তাহার মুখের পানে চাহিলাম।
সে বলিল, রমণীবাবু্, ‘রেবার হাতের লেখা যোগাড় করতে পারেন?’
‘হাতের লেখা!’ রমণীবাবু ভ্রূ তুলিলেন।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ধরুন, তার হিসেবের খাতা, কিংবা চিঠির ছেড়া টুকরো।…যাতে বাংলা লেখার ছাঁদটা পাওয়া যায়।’
রমণীবাবু গালে হাত দিয়া চিন্তা করিলেন, শেষে বলিলেন, ‘চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু মতলবটা কি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘মতলবটা এই।–রেবা আমার রহস্য-কাহিনী পড়তে ভালবাসতো। সুতরাং অটোগ্রাফের জন্যে আমাকে চিঠি লেখা তার পক্ষে অসম্ভব নয়। মেয়েদের যে ও দুর্বলতা আছে তার পরিচয় আমরা হামেশাই পেয়ে থাকি। মনে করুন। ছ’মাস আগে রেবা আমাকে চিঠি লিখেছিল; আমার অটোগ্রাফ চেয়েছিল, তারপর আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল যে, তার স্বামী তাকে খুন করবার ফন্দি আঁটিছে, আমি যদি তার অপঘাত মৃত্যুর খবর পাই তাহলে যেন তদন্তু করি।’