আমার প্রণাম নেবেন।
ইতি—বিনীত
রেবা সরকার
চিঠিখানি ভাঁজ করিয়া ব্যোমকেশ একটি পুরানো খামের মধ্যে ভরিয়া রাখিল।
বেলা তিনটার সময় রমণীবাবু আসিলেন, সঙ্গে একজন ছোকরা পুলিস। সে রেডিও মিস্ত্রী; তাহার হাতে টেপ-রেকর্ডারের বাক্স এবং মাইক ইত্যাদি যন্ত্রপাতি।
রমণীবাবু ব্যোমকেশের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া মিস্ত্রীকে বলিলেন, ‘বীরেন, তাহলে তুমি লেগে যাও।’
‘আজ্ঞে স্যার’ বলিয়া বীরেন লাগিয়া গেল।
বসিবার ঘরে টেবিলের মাথায় যে ঝোলানো বৈদ্যুতিক আলোটা ছিল তাহার তারে মাইক লাগানো হইল, টেপ-রেকডার যন্ত্রটা বসানো হইল ব্যোমকেশের শয়ন ঘরে। রেকড়ার চালু হইলে একটু শব্দ হয়, যন্ত্রটা অন্য ঘরে থাকিলে যন্ত্রের শব্দ বসিবার ঘরে শোনা যাইবে না।
সব ঠিকঠাক হইলে বীরেন পাশের ঘরে গিয়া দ্বার বন্ধ করিল। আমরা বসিবার ঘরে টেবিলের পাশে বসিয়া সহজ গলায় কথাবার্তা বলিলাম; তারপর পাশের ঘরে গেলাম। বীরেন যন্ত্রের ফিতা উল্টাদিকে ঘুরাইয়া আবার চালু করিল, তখন আমরা নিজেদের কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইলাম। বেশ স্পষ্ট আওয়াজ, কোনটা কাহার গলা চিনিতে কষ্ট হয় না।
ব্যোমকেশ সস্তুষ্ট হইয়া বলিল, ‘চলবে।–চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছেন?’
রমণীবাবু বলিলেন, ‘দিয়েছি। আসবে নিশ্চয়। যার মনে পাপ আছে, ও চিঠি পাবার পর তাকে আসতেই হবে। আপনি তাকে ব্ল্যাকমেল করতে চান। কিনা সেটা সে জানতে চাইবে। আচ্ছা, আমরা এখন যাই, আবার সন্ধ্যের পর আসব।’
৩
ঠিক ছ’টার সময় বীরেনকে লইয়া রমণীবাবু আসিলেন; পুলিসের গাড়ি তাঁহাদের নামাইয়া দিয়া চলিয়া গেল।
রমণীবাবু বলিলেন, ‘একটু আগেই এলাম। কি জানি সুনীল যদি সাতটার আগে এসে উপস্থিত হয়।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বেশ করেছেন। প্রথমে আপনারা পাশের ঘরে থাকবেন, যাতে সুনীল জানতে না পারে যে, পুলিসের সঙ্গে আমার যোগ আছে। আমি আর অজিত বসবার ঘরে থাকব; সুনীল আসার পর আপনি তাক বুঝে আমাদের সঙ্গে যোগ দেবেন।’
‘সে ভাল কথা।’ রমণীবাবু বীরেনকে লইয়া পাশের ঘরে গেলেন এবং দরজা ভেজাইয়া দিলেন। আমরা দু’জনে আসার সাজাইয়া অপেক্ষা করিয়া রহিলাম।
ক্রমে অন্ধকার হইল। আমি আলো জ্বালিয়া দিয়া বসিলাম। ব্যোমকেশ সকালবেলার সংবাদপত্রটা তুলিয়া লইয়া চোখ বুলাইতে লাগিল। আমি সিগারেট ধরাইলাম। কান দুটা অতিমাত্রায় সচেতন হইয়া রহিল।
সাতটা বাজিবার কয়েক মিনিট আগেই ডাকবাংলোর সদরে একটি মোটর আসিয়া থামার শব্দ শোনা গেল; আমরা দৃষ্টি বিনিময় করিলাম। মিনিট দুই-তিন পরে সুনীল সরকার দ্বারের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।
রমণীবাবু যে বৰ্ণনা দিয়াছিলেন তাহার সহিত বিশেষ গরমিল নাই; উপরন্তু লক্ষ্য করিলাম, তাহার বিভক্ত ওষ্ঠ্যাধরের ফাঁকে দাঁতগুলা কুমীরের দাঁতের মত হিংস্ব। ভোঁতা মুখে ধারালো দাঁত। সব মিলাইয়া চেহারাটি নয়নরঞ্জন নয়। তার উপর দুশ্চরিত্র। পতিভক্তিতে রেবা হয়তো সীতা-সাবিত্রীর সমতুল্য ছিল না, কিন্তু সেজন্য তাঁহাকে দোষ দেওয়া যায় না। সুনীল সরকার স্পষ্টতাই রাম কিংবা সত্যবানের সমকক্ষ নয়।
সুনীল বোকার মত কিছুক্ষণ দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া রহিল, শেষে ভাঙা ভাঙা গলায় বলিল, ‘ব্যোমকেশবাবু—’
ব্যোমকেশ খবরের কাগজের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া বসিয়াছিল, ঘাড় ফিরাইয়া বলিল, ‘সুনীলবাবু? আসুন।’
ন্যালা-ক্যাবলার মত ফ্যালফেলে মুখের ভাব লইয়া সুনীল টেবিলের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল; কে বলিবে তাহার ঘটে গোবর ছাড়া আর কিছু আছে! ব্যোমকেশ শুষ্ক কঠিন দৃষ্টিতে তাহাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, ‘আপনার অভিনয় ভালই হচ্ছে, কিন্তু যতটা অভিনয় করছেন ততটা নির্বোধ আপনি নন। —বসুন।’
সুনীল থাপ করিয়া চেয়ারে বসিয়া পড়িল, সুবর্তুল চক্ষে ব্যোমকেশকে পরিদর্শন করিয়া স্বলিত স্বরে বলিল, ‘কী— কী বলছেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কিছু না। আপনি যখন বোকামির অভিনয় করবেনই তখন ও আলোচনায় লাভ নেই। —সুনীলবাবু্, পৈতৃক সম্পত্তি ফিরে পাবার জন্যে আপনি দুটো মানুষকে খুন করেছেন; এক, আপনার স্ত্রী; দুই, হুকুম সিং। এখানে এসে আমি সব খবর নিয়েছি। আপনি হুকুম সিংকে দিয়ে স্ত্রীকে খুন করিয়েছিলেন, তারপর নিজের হাতে হুকুম সিংকে মেরেছিলেন। হুকুম সিং ছিল আপনার ষড়যন্ত্রের অংশীদার, তাই তাকে সরানো দরকার ছিল; সে বেঁচে থাকলে সারা জীবন ধরে আপনাকে দোহন করত। আপনি এক টিলে দুই পাখি মেরেছেন।’
সুনীল হ্যাঁ করিয়া শুনিতেছিল, হাউমাউ করিয়া উঠিল, ‘এ কি বলছেন। আপনি! রেবাকে আমি মেরেছি! এ কি বলছেন! একটা গুণ্ডা-যার নাম হুকুম সিং-সে। আমার স্ত্রীকে গলা টিপে মেরেছিল। আন্না দেখেছে-আন্না নিজের চোখে দেখেছে। হুকুম সিং রেবাকে গলা টিপে মারছে–’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হুকুম সিং ভাড়াটে গুণ্ডা, তাকে আপনি টাকা খাইয়েছিলেন।’
‘না না, এসব মিথ্যে কথা। রেবাকে আমি খুন করাইনি; সে আমার স্ত্রী, আমি তাকে ভালবাসতাম—’
‘আপনি রোবাকে কি রকম ভালবাসতেন, তার প্রমাণ আমার পকেটে আছে—’ বলিয়া ব্যোমকেশ নিজের বুক-পকেটে আঙুলের টোকা মারিল।
‘কী? রেবার চিঠি? দেখি কি চিঠি রেবা আপনাকে লিখেছিল।’
ব্যোমকেশ চিঠি বাহির করিয়া সুনীলের হাতে দিতে দিতে বলিল, ‘চিঠি ছিঁড়বেন না। ওর ফটো-স্ট্যাট্ নকল আছে।’
ফুল তাহার সতর্কবাণী শুনিতে পাইল না, চিঠি খুলিয়া দুহাতে ধরিয়া একাগ্রচক্ষে পড়িতে লাগিল।
এই সময় নিঃশব্দে দ্বার খুলিয়া রমণীবাবু ব্যোমকেশের চেয়ারের পাশে আসিয়া দাঁড়াইলেন। দু’জনের দৃষ্টি বিনিময় হইল; ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িল।