অদৃশ্য ত্রিকোণ

চিঠি পড়া শেষ করিয়া সুনীল যখন চোখ তুলিল তখন প্রথমেই তাহার দৃষ্টি পড়িল রমণীবাবুর উপর। পলকের মধ্যে তাহার মুখ হইতে নিবুদ্ধিতার মুখোস খসিয়া পড়িল। ভোঁতা মুখে। ধারালো দাঁত নিষ্ক্রান্ত করিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল‌, ‘ও-এই ব্যাপার। পুলিসের ষড়যন্ত্র! আমাকে ফাঁসাবার চেষ্টা।–ব্যোমকেশবাবু্‌, রেবার মৃত্যুর জন্যে দায়ী কে জানেন? ঐ রমণী দারোগা।’ বলিয়া রমণীবাবুর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিল।

আমরা সুনীলের দিক হইতে পাল্টা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না‌, ব্যোমকেশ সবিস্ময়ে ভ্রূ তুলিয়া বলিল‌, রমণীবাবু দায়ী! তার মানে?’

সুনীল বলিল‌, ‘মানে বুঝলেন না? রমণী দারোগা রেবার প্রাণের বন্ধু ছিল‌, যাকে বলে বঁধু। তাই তো আমার ওপর রমণী দারোগার এত আক্ৰোশ।’

ঘর কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। আমি রমণীবাবুর মুখের পানে তাকাইলাম। তিনি একদৃষ্টি সুনীলের পানে চাহিয়া আছেন; মনে হয় তাহার সমস্ত দেহ তপ্ত লোহার মত রক্তবর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। ভয় হইল এখনি বুঝি একটা অগ্নিকাণ্ড হইয়া যাইবে।

ব্যোমকেশ শান্ত স্বরে বলিল‌, ‘তাহলে এই কারণেই আপনি স্ত্রীকে খুন করিয়েছেন?’

সুনীল বলিল‌, ‘আমি খুন করাইনি। এই জাল চিঠি দিয়ে আমাকে ধরবেন ভেবেছিলেন ‘ সুনীল চিঠিখানা মুঠির মধ্যে গোলা পাকাইয়া টেবিলের উপর ফেলিয়া দিল—’সুনীল সরকারকে ধরা অত সহজ নয়। চললাম। যদি ক্ষমতা থাকে আমাকে গ্রেপ্তার করুন‌, তারপর আমি দেখে নেব।’,

আমরা নির্বাক বসিয়া রহিলাম‌, সুনীল ময়াল সাপের মত সর্পিল গতিতে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

এই কয়েক মুহুর্তে সুনীলের চরিত্র যেন চোখের সামনে মূর্তি ধরিয়া দাঁড়াইল। সাপের মত খল কপট নৃশংস‌, হঠাৎ ফণা তুলিয়া ছোবল মারে‌, আবার গর্তের মধ্যে অদৃশ্য হইয়া যায়। সাংঘাতিক মানুষ।

রমণীবাবু একটা অতিদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন। ব্যোমকেশ কতকটা নিজমনেই বলিল‌, ‘ধরা গেল না।’

সহসা বাহির হইতে একটা চাপা গোঙানির আওয়াজ আসিল। সকলে চমকিয়া উঠিলাম। সর্বাগ্রে ব্যোমকেশ উঠিয়া দ্বারের পানে চলিল‌, আমরা তাহার পিছন পিছন চলিলাম।

ডাকবাংলোর সামনে সুনীলের মোটর দাঁড়াইয়া আছে এবং তাহার সামনের চাকার পাশে মাটির উপর যে মূর্তিটা পড়িয়া আছে তাহা সুনীলের। তাহার পিঠের উপর হইতে একটা ছুরির মুঠ উঁচু হইয়া আছে।

মৃত্যুযন্ত্রণায় সুনীল কাৎ হইবার চেষ্টা করিল; আমি ও ব্যোমকেশ তাহাকে সাহায্য করিলাম বটে‌, কিন্তু অন্তিমকালে আমাদের সাহায্য কোনও কাজে আসিল না। সুনীল একবার চোখ মেলিল; আমাদের চিনিতে পারিল কিনা বলা যায় না‌, কেবল অস্ফুট স্বরে বলিল‌, ‘মুকুন্দ সিং–’

তারপর তাহার হৃৎস্পন্দন থামিয়া গেল।

পথের সামনে ও পিছন দিকে তাকাইলাম‌, কিন্তু কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না; পথ জনশূন্য। আমার ব্বিশ মস্তিষ্কে একটা প্রশ্ন ঘুরিতে লাগিল-মুকুন্দ সিং কে? নামটা চেনা-চেনা। তারপর মনে পড়িয়া গেল‌, হুকুম সিং-এর ভাইয়ের নাম মুকুন্দ সিং। মুকুন্দ সিং ভ্ৰাতৃহত্যার প্রতিশোধ লইয়াছে।

লাশ চালান দেওয়া এবং আইনঘটিত অন্যান্য কর্তব্য শেষ করিতে সাড়ে নটা বাজিয়া গেল। আমরা ফিরিয়া আসিয়া বসিলাম। রমণীবাবুও ক্লান্তমুখে আসিয়া আমাদের সঙ্গে বসিলেন। বীরেন তখনও পাশের ঘরে যন্ত্র লইয়া অপেক্ষা করিতেছিল‌, রমণীবাবু তাহাকে ডাকিয়া বলিলেন‌, ‘তুমি যাও‌, যন্ত্রটা থাক। আমি নিয়ে যাব।’

বীরেন চলিয়া গেল।

কিছুক্ষণ তিনজনে সিগারেট টানিলাম। তারপর ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘সুনীল আইনকে ফাঁকি দিয়েছিল বটে কিন্তু নিয়তির হাত এড়াতে পারল না। আশ্চর্য! মাঝে মাঝে গুণ্ডারাও অনেক নৈতিক সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে।’

রমণীবাবু বলিলেন‌, ‘একটা সমস্যার সমাধান হল‌, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আর একটা সমস্যা তৈরি হল। এখন মুকুন্দ সিংকে ধরতে হবে। আমার কাজ শেষ হল না‌, ব্যোমকেশবাবু।’

কিছুক্ষণ নীরবে সিগারেট টানিবার পর ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘সুনীলের অভিযোগ সত্যি–কেমন?’

রমণীবাবু নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ। আমার আর রেবার বাড়ি এক শহরে‌, এক পাড়ায়। ওকে ছেলেবেলা থেকে চিনতাম‌, কিন্তু ভালবাসা-বাসি ছিল না…তারপর রেবার যখন ওই রাক্ষসটার সঙ্গে বিয়ে হল তখন এই শহরেই ওর সঙ্গে আবার দেখা হল…রেবা মন্দ ছিল না‌, কিন্তু কি জানি কেমন করে কী হয়ে গেল…সুনীল যে জানতে পেরেছে তা একবারও সন্দেহ হয়নি…সুনীলকে আহাম্মক ভেবেছিলাম‌, তারপর রেবা যখন মারা গেল তখন বুঝলাম সুনীল কেউটে সাপ…তারপর ফাঁসাবার চেষ্টা করেছিলাম…শেষে আপনি এলেন‌, আপনার সাহায্যে শেষ চেষ্টা করলাম—’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘যে চিঠির ছেড়া অংশটা আপনি আমাকে দিয়েছিলেন সেটা রেবা আপনাকে লিখেছিল?’

রমণীবাবু বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ। আমাদের দেখাশোনা বেশি হত না। রেবা আমাকে চিঠি লিখত‌, মনের-প্ৰাণের কথা লিখত। অনেক চিঠি লিখেছিল।–কিন্তু রেবার কথা আর নয়‌, ব্যোমকেশবাবু। এখন বলুন টেপ-রেকর্ডের কী হবে?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কি আর হবে‌, ওটা মুছে ফেলা যাক। —আসুন।’

পাশের ঘরে গিয়া আমরা রেকর্ডার চালাইলাম। সদ্যমৃত সুনীলের জীবন্ত কণ্ঠস্বর শুনিলাম। তারপর ফিতা মুছিয়া ফেলা হইল।

(সমাপ্ত)

0 Shares