অদ্বিতীয়

তক্তপোশের পাশে চেয়ার টানিয়া আমি চিঠি পড়িতে আরম্ভ করিলাম। হাতের লেখা খুব স্পষ্ট নয়‌, একটু কষ্ট করিয়া পড়িতে হয়; কিন্তু ভাষা বেশ ঝরঝরে–

শ্ৰীব্যোমকেশ বক্সী মহাশয় সমীপে

সবিনয় নমস্কারপূর্বক নিবেদন,

আমার নাম শ্ৰীচিন্তামণি কুণ্ডু। পুলিস আমাকে খুনের মামলায় জড়াইবার চেষ্টা করিতেছে‌, তাই নিরুপায় হইয়া আপনার শরণ লইয়াছি। শক্তি থাকিলে আমি আপনার সঙ্গে দেখা করিতাম‌, আমার বক্তব্য মুখে বলিলে আরও পরিষ্কার হইত। কিন্তু কয়েক বৎসর যাবৎ আমি পক্ষাঘাত রোগে পঙ্গু হইয়াছি‌, আমার বাম অঙ্গ অচল হইয়া পড়িয়াছে; ঘরের মধ্যে অল্প চলাফেরা করিতে পারি মাত্র। তাই বাধ্য হইয়া পত্র লিখিতেছি।

যে গুরুতর ব্যাপার ঘটিয়াছে তাহা বিবৃত করিবার পূর্বে আমার নিজের পরিচয় কিছু জানাইতে ইচ্ছা করি। আমার বয়স এখন সাতান্ন বৎসর; স্ত্রী-পুত্র নাই‌, কেবল তিনটি বাড়ি আছে। বাড়িগুলি ভাড়া দিয়াছি‌, তন্মধ্যে একটি বাড়ির দ্বিতলে দুইটি ঘর লইয়া আমি থাকি। ভৃত্য রামাধীন আমার পরিচর্যা করে।

শিরোনামায় ঠিকানা দেখিয়া বুঝিবেন আমি কলিকাতার পূর্ব-দক্ষিণ অঞ্চলে থাকি। রাস্তাটি বেশ চওড়া; যে-বাড়িতে আমি থাকি সেটি রাস্তার এক দিকে‌, আমার অন্য বাড়ি দু’টি প্রায় তাহার সামনাসামনি‌, রাস্তার অপর দিকে। এই বাড়ি দু’টি অপেক্ষাকৃত ছোট এবং একতলা; ইহাদের যমজ বাড়ি বলিতে পারেন। দু’টি বাড়ির মাঝখান দিয়া খিড়কির দিকে যাইবার সরু গলি আছে।

আমি রোগে পঙ্গু‌, দু’টি ঘরের মধ্যেই আমার জীবন। পক্ষাঘাত হওয়ার আগে আমি দালালি করিতাম‌, অনেক ছুটাছুটি করিয়াছি; ছুটাছুটি করিতেই আমি অভ্যস্ত। তাই এখন সারা বেলা জানালার সামনে বসিয়া থাকি‌, রাস্তার লোক চলাচল দেখি। একটি বাইনোকুলার কিনিয়াছি‌, তাহাই চোখে দিয়া দূরের দৃশ্য দেখি। বাইনোকুলার দিয়া অনেক বাড়ির ভিতরের দৃশ্যও দেখা যায়; আমার যমজ বাড়ির ভাড়াটেদের উপর নজর রাখিতে পারি। যাহাদের ক্ষমতা আছে। তাহারা সিনেমা থিয়েটার দেখে; আমি জানালায় বসিয়া সাদা চোখে প্রবহমান জীবনস্রোত দেখি এবং চোখে দূরবীন লোগাইয়া নেপথ্যদৃশ্য দেখি। কত বিচিত্র দৃশ্য যে দেখিয়াছি শুনিলে আশ্চর্য হইয়া যাইবেন। কিন্তু সে-কথা যাক।

মাস দেড়েক আগে পৌষ মাসের মাঝামাঝি একটি ছোকরা আমার সঙ্গে দেখা করিতে আসিল। বেঁটে-খাটো চেহারা‌, ঘাড়ে-ছোটা তামাটে রঙের চুল‌, তারতরে মুখ‌, নাকের নীচে ছোট্ট একটি প্রজাপতি-গোঁফ আছে। পরিধানে দামী বিলাতি পোশাক‌, তাহার উপর ক্যামেলাহেয়ার কাপড়ের ওভারকেট। দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া সসম্রামে বলিল‌, ‘আমার নাম তপন সেন। আসতে পারি?’

আমি তখন জানালার কাছে বসিয়া খবরের কাগজ পড়িতেছিলাম‌, মুখ তুলিয়া বলিলাম‌, ‘আসুন।’

তপন সেন আসিয়া একটা চেয়ার টানিয়া আমার সম্মুখে বসিল। আমি বলিলাম‌, কি দরকার বলুন তো?’

সে জানালার বাহিরে আঙুল দেখাইয়া বলিল‌, ‘আপনার জোড়া-বাড়ির একটা বাড়ি খালি হয়েছে। তাই এলাম‌, যদি আমাকে ভাড়া দেন।’

বাড়িটা কিছুদিন হইতে খালি পড়িয়া ছিল। আগের ভাড়াটে বাড়ি তছনছ করিয়া দিয়াছিল‌, আবার তাহা মেরামত ও চুনকাম করাইয়া রাখিয়াছিলাম; ঠিক করিয়াছিলাম ভাল ভাড়াটে না পাইলে ভাড়া দিব না। ছোকরাকে দেখিয়া শুনিয়া ভালই মনে হইল‌, সাজপোশাক হইতে অবস্থাপন্ন বলিয়া মনে হয়। জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘আপনার কি করা হয়?’

সে ওভারকেটের পকেট হইতে সিগারেটের কোটা বাহির করিয়া আবার রাখিয়া দিল; বোধ হয়। আমার ন্যায় বয়োবৃদ্ধের প্রতি সম্রমবশতাই সিগারেট ধরাইল না। বলিল‌, ‘খবরের কাগজের অফিসে চাকরি করি। নাইট এডিটার। সারা রাত কাজ করি আর সারা দিন ঘুমোই।’ বলিয়া একটু হাসিল।

প্রশ্ন করিলাম‌, ‘সংসারে কে কে আছে? সে স্মিতমুখে বলিল‌, ‘সবেমাত্র সংসার আরম্ভ করেছি। আমি আর আমার স্ত্রী। আর কেউ নেই।’

মনে মনে খুশি হইলাম। ছেলেপিলে থাকিলে বাড়ি নষ্ট করে‌, দেয়ালে কালি দিয়া ছবি আঁকে। বলিলাম‌, ‘বেশ‌, আপনাকে ভাড়া দেব। দেড় শো টাকা ভাড়া।’

সে ইতস্তত করিয়া বলিল‌, ‘আমার পক্ষে একটু বেশি হয়ে যায়–’

বলিলাম‌, সাজানো বাড়ি। খাট-বিছানা টেবিল-চেয়ার কাবার্ড সব পাবেন।’

‘আচ্ছা‌, তাহলে রাজী। বাড়িটা একবার দেখতে পারি কি?’

চাবি দিলাম‌, তপন সেন গিয়া বাড়ি দেখিয়া আসিল। তারপর দেড় শো টাকা বাহির করিয়া দিয়া বলিল‌, ‘এই নিন। এক মাসের ভাড়া।’

আমি টাকার রসিদ লিখিয়া দিয়া বলিলাম‌, কবে থেকে বাড়িতে আসবেন?

সে বলিল‌, ‘কাল ইংরেজি মাসের পয়লা। বাড়ি তো খালিই পড়ে আছে‌, যদি অনুমতি দেন আজই কোনো সময় আসতে পারি।’

বলিলাম‌, ‘বেশ‌, যখন ইচ্ছে আসবেন।’

তপন সেন চাবি লইয়া চলিয়া গেল। ভাল ভাড়াটে পাইয়াছি ভাবিয়া মনে মনে উৎফুল্প হইলাম।

সেদিন সারা বিকালবেলা জানালায় বসিয়া বাড়ির দিকে তাকাইয়া রহিলাম‌, কিন্তু তপন তাহার স্ত্রীকে লইয়া আসিল না।

সকালবেলা জানোলা খুলিয়া দেখি উহারা আসিয়াছে। সদর দরজা খোলা। নিশ্চয় রাত্রে কোনো সময় মালপত্র লইয়া আসিয়াছে।

আমার কৌতূহলী চক্ষু ওই দিকেই যাতায়াত করিতে লাগিল। বেলা সাড়ে ন’টার সময় একটি যুবতী আসিয়া ভিতর দিক হইতে সদর দরজা বন্ধ করিয়া দিল। তারপর কয়েক মিনিট গত হইলে খিড়কি দরজার গলি দিয়া সে বাহির হইয়া আসিল।

তখন তাহাকে ভাল করিয়া দেখিলাম। লম্বা ছিমছাম চেহারা‌, মাথায় একমাথা চুল এলো খোঁপার আকারে ঘাড়ের উপর বিন্যস্ত‌, হাতে একটি ছোট অ্যাটাচি-কেস। ভাবিলাম‌, সারা রাত কাজ করিয়া তখন ঘুমাইতেছে‌, তাই তার বউ বাজার করিতে চলিয়াছে।

0 Shares