অদ্বিতীয়

কিন্তু দুপুর কাটিয়া গেল সে ফিরিয়া আসিল না। একেবারে ফিরিল অপরাহ্নে আন্দাজ চারটার সময়। সদর দরজার কড়া নাড়িল না‌, গলি দিয়া খিড়কির দিকে চলিয়া গেল। বোধ হয়। স্বামী মহাশয়ের নিদ্ৰাভঙ্গ করিতে চায় না।

কিছুক্ষণ পরে আমি রামাধীনকে পাঠাইলাম। নূতন ভাড়াটে‌, তাহাদের সুবিধা অসুবিধার খোঁজ-খবর লওয়া দরকার। জানালায় বসিয়া দেখিলাম রামাধীন গিয়া দ্বারের কড়া নাড়িল। মেয়েটি দ্বার খুলিয়া দিল। রামান্ধীনের সহিত কথা বলিয়া মেয়েটি একবার চোখ তুলিয়া আমার জানালার পানে চাহিল‌, তারপর রামান্ধীনের সঙ্গে দ্বিতলে আমার কাছে উঠিয়া আসিল।

দূর হইতে তাহাকে দেখিয়াছিলাম‌, এখন কাছে হইতে দেখিলাম। ভারী সুশ্ৰী চেহারা‌, লম্বা একহারা‌, মেদ-গ্রিন্থির বাহুল্য নাই; বাঁ। গালের উপর মসুরের মত একটি লাল তিল‌, তাহাতে মুখের লালিত্য আরও বাড়িয়াছে। একটি বিষয় লক্ষ্য করিলাম‌, স্বামী-স্ত্রীর বয়স প্রায় একই রকম-তেইশ-চব্বিশ। হয়তো প্রেমে পড়িয়া বিবাহ করিয়াছে। আজকাল তো কতাই এমন দেখা যায়।

ছোট্ট নমস্কার করিয়া বলিল‌, ‘আমার নাম শাস্তা। আমাদের কোনো অসুবিধে নেই; খুব সুন্দর বাড়ি পেয়েছি।’ তাহার কথা বলিবার ভঙ্গী যেমন মিষ্ট‌, গলার স্বরও তেমনি নরম।

বলিলাম‌, ‘বসুন। আপনি-ই সে মাথা নাড়িয়া বলিল‌, ‘আমাকে ‘আপনি বলবেন না। আমি আপনার মেয়ের বয়সী।’

বলিলাম‌, ‘তা-আচ্ছা। তোমাদের বি-চাকর যদি দরকার থাকে‌, নতুন পাড়ায় এসেছ-’

সে বলিল‌, ‘ঝি-চাকরের দরকার নেই। দু’জনের সংসার‌, আমি একাই সব কাজ সামলে নিতে পারব।’

বলিলাম‌, ‘বেশ বেশ। তা-আজ তুমি সকালবেলা বেরিয়েছিলে‌, এখন ফিরলে। সারা দিন কোথায় ছিলে?’

সে বলিল‌, ‘আমি স্কুলে পড়াই। চেতলার দিকে একটা ছোট মেয়েদের স্কুল আছে‌, সেখানে শিক্ষয়িত্রীর কাজ করি।–আচ্ছা‌, আজ যাই‌, ওর খাবার তৈরি করতে হবে। সন্ধ্যার পর ও কাজে বেরুবে।’ শান্তা একটু হাসিয়া ঘাড় হেলাইয়া চলিয়া গেল।

ইহাদের দু’জনকেই আমার ভাল লাগিয়াছে। বর্তমানে ভাড়াটেদের লইয়াই আমার জীবন। তাহারা আমার বাড়িতে বাস করে‌, ভাড়া দেয়‌, নিজের ধান্দায় থাকে; মেলামেশা নাই। জোড়া-বাড়ির অন্য অংশে একটি মাদ্রাজী পরিবার থাকে; তাহারা আমার ভাষা বোঝে না‌, কেবল মাসান্তে ভাড়া দিয়া রসিদ লইয়া যায়। ইহাদের সহিত আমার হৃদয়ের কোনও যোগ নাই। কিন্তু এই নবীন বাঙালী দম্পতি আমার হৃদয় আকর্ষণ করিয়াছে।

জানালায় বসিয়া দেখিলাম‌, সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইবার পর তপন কোট প্যান্ট ও ওভারকেট চড়াইয়া খিড়কির গলি দিয়া বাহির হইল, বাড়ির সামনে ল্যাম্পের নীচে দাঁড়াইয়া সিগারেট ধরাইল, তারপর বাস-রাস্তার দিকে চলিয়া গেল। সারা রাত বাহিরে থাকিবে‌, ভোরের দিকে কাজ শেষ করিয়া ফিরিবে।

অতঃপর উহাদের নিয়ম-বাঁধা জীবনযাত্ৰা চলিতে লাগিল। সকালে সাড়ে ন’টার সময় শান্তা স্কুলে পড়াইতে চলিয়া যায়‌, বিকালে ফিরিয়া আসে। তপন সন্ধ্যার পর বাহির হয়‌, রাত্রে কখন ফেরে জানি না। উহাদের জীবনযাত্রা অতি শান্ত; বাড়িতে অতিথি আসে না‌, হয়তো বন্ধুবান্ধব চেনা-পরিচিত কেহ কাছাকাছি নাই। তপন বাড়ি হইতে রাত্রে বাহির বাহির হইবার পর বাড়ির ইলেকট্রিক বাতি নিবিয়া যায়‌, কেবল সামনের ঘরে মৃদু মোমবাতি জ্বলে। তাহাও আটটা বাজিতে না বাজিতে নিবিয়া যায়। শান্তা বোধ হয়। সারা দিনের ক্লান্তির পর তাড়াতাড়ি শুইয়া পড়ে।

উহাদের বিষয়ে আমার মনে যথেষ্ট কৌতূহল আছে‌, তাই যখন তখন চোখে দূরবীন লোগাইয়া বাড়িটা দেখি। কিন্তু বাহির হইতে বাড়ির অভ্যন্তর কিছুই দেখা যায় না; সদর দরজা। যেমন বন্ধ থাকে‌, সদরের জানালায় তেমনি পদার্স টানা থাকে। কেবল রাত্রিকালে পদার ভিতর দিয়া মোমবাতির মোলায়েম আলো দেখা যায়।

একদিন রবিবার সকালবেলা শান্তা আসিয়া খানিকক্ষণ আমার সঙ্গে গল্পসল্প করিল। আমি রহস্যচ্ছলে জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘তোমার কতটি এখনো ঘুমোচ্ছেন বুঝি?’

সে সলজ্জভাবে বলিল‌, ‘হ্যাঁ‌, সারা রাত ঘুমোতে পায় না‌, তাই—’

আমি বলিলাম‌, ‘তুমি রাত্রে ইলেকট্রিক বাতি জ্বালাও না দেখেছি। কেন বল দেখি?’

শান্তা সচকিত হইয়া বলিল‌, ‘আমার চোখ ভাল নয়‌, উজ্জ্বল আলো বেশিক্ষণ সহ্য হয় না। ও আবার কম আলোয় দেখতে পায় না। তাই ও চলে গেলেই ইলেকট্রিক নিবিয়ে পিদিম জ্বলি। আপনি লক্ষ্য করেছেন বুঝি?’

‘হ্যাঁ। আমি তো সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত এই জানালার ধারেই বসে থাকি।’

শান্তা সহানুভূতিপূর্ণ স্বরে বলিল‌, ‘সত্যি, আপনার তো কোথাও যাবার উপায় নেই। তা আমি মাঝে মাঝে আসব‌, ওকেও পাঠিয়ে দেব।’

এইভাবে চলিতেছে। একদিন সন্ধ্যার পর তপন ও কাজে যাইবার পথে আমার কাছে আসিয়া দুই চারিটা কথা বলিয়া গেল।

তারপর একদিন গভীর রাত্রে একটি ব্যাপার লক্ষ্য করিলাম।

আমি সাধারণত রাত্রি সাড়ে ন’টার সময় শয়ন করি। কিন্তু আমার অনিদ্রা রোগ আছে‌, মাঝে মাঝে রাত্রে ঘুম হয় না‌, তখন প্রায় সারা রাত জাগিয়া থাকি। দুই হস্তা আগে রাত্রে যথাসময় শয়ন করিলাম। কিন্তু কিছুঁতেই ঘুম আসিল না। বারোটা পর্যন্ত সাধ্যসাধনা করিয়া উঠিয়া পড়িলাম; ভাবিলাম এক পেয়ালা গরম কোকো পান করিলে ঘুম আসিতে পারে। স্টোভ জ্বালিয়া জল চড়াইয়া দিলাম। রামাধীন আমার ঘরের বাহির দ্বারের সম্মুখে শয়ন করে, তাহাকে আর জাগাইলাম না।

শীতের রাত্রি‌, জানালা বন্ধ আছে। হঠাৎ কি মনে হইল‌, জানালার খড়খড়ি তুলিয়া বাহিরে তাকাইলাম। নিষুতি রাত্রে রাস্তায় জনমানব নাই; জোড়া-বাড়ির সামনে রাস্তার আলোটা জ্বলিতেছে। বাড়ি দুটোর ভিতরে অন্ধকার।

0 Shares