অদ্বিতীয়

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ব্যাপারটাই হাসির। চিন্তামণি কুণ্ডু মশায় কিন্তু একটি বিষয়ে ভুল করেছেন‌, তপনের বাড়িতে বিদ্যুৎবাতি নিবে যাওয়ার সময়টা তিনি ভাল করে লক্ষ্য করেননি।’

‘তুমি কি করে তা জানলে?’

‘আমার অনুমান যদি সত্যি হয় তাহলে তিনি নিশ্চয় ভুল করেছেন। আর একটা ভুল করেছেন‌, সেটা অবশ্য স্বাভাবিক।’ ব্যোমকেশ আবার মৃদু বঙ্কিম হাসিতে লাগিল। তারপর গম্ভীর হইয়া বলিল‌, ‘অজিত‌, চিন্তামণিবাবুর ঘরে টেলিফোন আছে‌, তুমি তাঁর নম্বর খুঁজে তাঁকে ফোন কর। একটা জরুরী প্রশ্নের উত্তর দরকার। তাঁকে জিজ্ঞেস কর তপনের গলার আওয়াজ কি রকম।’

‘নিশ্চয় খুব জরুরী প্রশ্ন। আর কিছু জানতে চাও?’

‘আর কিছু না। তাঁকে বোলো‌, ভাবনার কিছু নেই‌, আমি অবিলম্বে যাচ্ছি।’

চিন্তামনিবাবুকে ফোন করিলাম, তারপর ফিরিয়া আসিয়া বলিলাম, ‘তপনের গলার আওয়াজ চেরা-চেরা।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘চেরা-চেরা! তাহলে ঠিক ধরেছি‌, আর কোন সন্দেহ নেই।’

বলিলাম‌, ‘কি ধরেছ তুমিই জান। কিন্তু চিন্তামণিবাবুর গলাও চেরা-চেরা মনে হল।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তাতে আর আশ্চর্য কি। একে পক্ষাঘাত‌, তার ওপর পুলিসের আতঙ্ক–চল‌, বেরিয়ে পড়া যাক। কাজ সেরে ফিরে এসে মধ্যাহ্ন ভোজন করা যাবে।’

চিন্তামণিবাবুর বাড়ির রাস্তাটা বেশ চওড়া নূতন রাস্তা; শহরের অন্তিম প্রান্তে বলিয়া অপেক্ষাকৃত নির্জন। তপন সেনের বাসা পুলিসের পাহারা দেখিয়া সহজেই সনাক্ত করা গেল। তাহার উল্টাদিকে চিন্তামণিবাবুর দ্বিতল বাড়ি। আমরা উপরে উঠিয়া গেলাম।

আমরা দ্বারের কড়া নাড়িবার পূর্বেই হিন্দুস্থানী ভৃত্য রামাধীন দ্বার খুলিয়া পাশে সরিয়া দাঁড়াইল। আমরা প্রবেশ করিলাম। খোলা জানালার পাশে চিস্তামণিবাবু চেয়ারে বসিয়া ছিলেন‌, সাগ্রহে গলা বাড়াইয়া বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু। রাস্তায় আসতে দেখেই চিনেছি।‌, আসুন।’

রামাধীন দু’টি চেয়ার আগাইয়া দিল‌, আমরা বসিলাম। টেলিফোনে গলার আওয়াজ শুনিয়া চিন্তামণিবাবুর চেহারা যেমন আন্দাজ করিয়াছিলাম আসলে তেমন নয়; কৃষ্ণবৰ্ণ মোটাসোটা মানুষ‌, উপবিষ্ট অবস্থায় দেখিয়া পক্ষাঘাতগ্রস্ত বলিয়া মনে হয় না। তাঁহার পাশে টিপাই-এর উপর একটি দামী বাইনোকুলার রাখা রহিয়াছে।

চিন্তামণিবাবু বলিলেন‌, ‘আগে কি খাকেন বলুন।—চা—কোকো–ওভালটিন—’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এখন কিছু দরকার নেই। —পুলিস আজ আপনার কাছে এসেছিল নাকি?’ চিন্তামণিবাবু বলিলেন‌, ‘আসেনি আবার! দারোগা একবার আমার দিকে তেড়ে আসছে‌, একবার ও বাড়িতে শান্তার দিকে তেড়ে যাচ্ছে। কী যে চায় ওরা বুঝি না। একই প্রশ্ন পঞ্চাশবার। আমার পক্ষাঘাত হয়েছে‌, সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে পারি কিনা‌, বাইনোকুলার রেখেছি কেন‌, তপন সেনকে বাড়ি ভাড়া দিয়েছি কেন? বলুন দেখি ব্যোমকেশবাবু্‌, এ সব প্রশ্নের কী জবাব দেব? জবাব দিতে দিতে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছে। এখন আপনি আমাকে বাঁচান।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ভাববেন না‌, সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন দারোগাবাবুর সঙ্গে একবার দেখা করা দরকার। তিনি কি–’

বলিতে বলিতে দারোগাবাবু দ্বারের সামনে আসিয়া দাঁড়াইলেন।

দশ বারো বছর আগে বিজয় ভাদুড়ী যখন ছোট দারোগা ছিলেন তখন তাঁহার সহিত পরিচয় হইয়াছিল। রোগী লম্বা বেউড় বাঁশের মত চেহারা‌, কিন্তু অত্যন্ত কর্মতৎপর ও সন্দিগ্ধচিত্ত ব্যক্তি। দশ বছরে তিনি বড় দারোগ হইয়াছেন। কিন্তু চেহারার তিলমাত্র পরিবর্তন ঘটে নাই। এবং মনও যে পূর্ববৎ সন্দেহপরায়ণ আছে তাহা তাঁহার চোখের দৃষ্টি হইতে অনুমান করা যায়।

দ্বারের নিকট হইতে প্রখর চক্ষে আমাদের নিরীক্ষণ করিয়া তিনি ঘরে প্রবেশ করিলেন‌, শুষ্ক স্বরে বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু যে!’

ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল‌, ‘চিনতে পেরেছেন দেখছি। তা–আপনার আসামী‌, মানে‌, তপন সেন ধরা পড়ল?’

বিজয় ভাদুড়ী একবার চিন্তামণিবাবুকে বক্রদৃষ্টিতে বিদ্ধ করিয়া বলিলেন, ‘ধরে পড়েনি এখনো, কিন্তু যাবে কোথায়? আপনি হঠাৎ এখানে কী উদ্দেশ্যে‌, ব্যোমকেশবাবু?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘চিন্তামণিবাবু আমার মক্কেল। ওঁর বাড়িতে খুন হয়েছে‌, ওঁর ভাড়াটে খুন করেছে‌, আপনারা ওঁকে বিরক্ত করছেন। তাই নিজের স্বার্থরক্ষার জন্যে উনি আমাকে নিযুক্ত করেছেন।’

বিজয় ভাদুড়ী কুটিল-কুঞ্চিত চক্ষে ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া রহিলেন‌, বোধ করি মনে মনে বিবেচনা করিলেন ব্যোমকেশকে গলা-ধাক্কা দিবেন কি না। তারপর তিনি যখন কথা বলিলেন তখন তাঁহার সুর একেবারে বদলাইয়া গিয়াছে। তিনি ব্যোমকেশের দিকে ঝুঁকিয়া ঈষৎ হ্রস্বকণ্ঠে বলিলেন‌, ‘একবার বাইরে আসবেন? দুটো কথা আছে।’

‘চলুন।’

আমরা ঘরের বাহিরে লম্বা বারান্দার এক কোণে গিয়া দাঁড়াইলাম। বিজয়বাবু মুখে একটা জোর করা হাসি টানিয়া আনিয়া বলিলেন‌, ‘দেখুন ব্যোমকেশবাবু্‌, উঁচু মহলে আপনার প্রতিপত্তি আছে‌, আপনি যদি এ মামলায় মাথা গলাতে চান আমি আপনাকে আটকাতে পারব না। কিন্তু আমি অনুরোধ করছি আপনি চিন্তামণি কুণ্ডুকে সাহায্য করবেন না। আমার বিশ্বাস‌, ও আর ঐ খোট্টা চাকরিটা তলে তলে এই ব্যাপারের সঙ্গে জড়িত আছে।’

ব্যোমকেশ স্থির হইয়া বিজয়বাবুর কথা শুনিল‌, তারপর বলিল‌, ‘কে খুন করেছে আপনি জানেন?’

বিজয়বাবু বলিলেন‌, ‘অবশ্য খুন করেছে তপন সেন‌, কিন্তু বুড়োটাও এর মধ্যে আছে।’

‘বুড়োটাও যদি এর মধ্যে থাকতো তাহলে তপনের নামে খুনের অভিযোগ আনতো কি?’

‘ঐখানেই চালাকি। তপনকে ধরিয়ে দিয়ে বুড়ো নিজেকে বাঁচাতে চায়।’

0 Shares