ব্যোমকেশ বিরক্ত স্বরে বলিল, ‘মাপ করবেন বিজয়বাবু্, আপনি এ মামলার কিছুই বুঝতে পারেননি।’
ভ্রূকুটি করিয়া বিজয়বাবু বলিলেন, ‘তার মানে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘মানে পরে বলব। আগে আপনি আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দিন দেখি।–যে ছুরি দিয়ে খুন হয়েছিল সেটা পাওয়া গেছে কি?’
‘না। তপন সেটা নিয়ে পালিয়েছে।’
‘তপনের বাড়ি তল্লাশ করে কিছু পেয়েছেন?’
‘না, এমন কিছু পাইনি যাতে হদিস পাওয়া যায়। তবে সিন্দুকটা এখনো খোলা হয়নি, তার চাবি তপনের কাছে।’
‘শান্তাকে জেরা করে কিছু পেয়েছেন?’
‘কাজের কথা কিছু পাইনি। মাস চারেক আগে ওদের বিয়ে হয়েছে; স্বামীর কাজকর্মের কথা শান্তা কিছুই জানে না।’
‘আমি কিন্তু সব জানি। কে খুন করেছে জানি, এমন কি আসামী কোথায় আছে তাও জানি—’
বিজয়বাবু লাফাইয়া উঠিলেন, ‘জানেন তবে এতক্ষণ বলেননি কেন?’
ব্যোমকেশ হাসিল, ‘সময় হলেই বলব। তার আগে আমি তপনের বাসাটা একবার ঘুরে ফিরে দেখতে চাই। আর শাস্তাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। আপনি অবশ্য তাকে যথেষ্ট জেরা করেছেন এবং সন্তোষজনক উত্তরও পেয়েছেন। আমি কেবল দুচারটে প্রশ্ন করব।’
বিজয়বাবু বলিলেন, ‘তা বেশ। কিন্তু আসামী–’
‘আসামীকেও পাবেন।’
‘কোথায়? ওই বাড়িতে? আপনি কী বলছেন কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘পারবেন। আগে চলুন ওই বাড়িতে। আসামীকে ধরার জন্যে প্রস্তুত থাকবেন।’
‘তার মানে-আপনি বলতে চান তপন সেন বাসায় ফিরে আসবে, কিম্বা বাসাতেই লুকিয়ে আছে–?’
‘আসুন আসুন—’ ব্যোমকেশ অগ্রগামী হইয়া সিঁড়ির দিকে চলিল, চিন্তামণিবাবুর দ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইয়া বলিল, ‘চিন্তামণিবাবু্, আপনি নিৰ্ভয়ে থাকুন। আমরা একবার ও বাড়িতে যাচ্ছি, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই খুনের কিনারা হয়ে যাবে।’
তারপর আমরা সিঁড়ি দিয়ে নামিয়া গেলাম।
তপনের বাসার বুকে-পিঠে পুলিস পাহারা। একটি বিচিত্র ব্যাপার লক্ষ্য করিয়াছি, চোর পালাইলে পুলিসের বুদ্ধি বাড়ে। অপরাধী যখন অপরাধ করিয়া চম্পট দিয়াছে তখন অকুস্থলের চারিপাশে কড়া পাহারা বসাইয়া কী লাভ হয় আমি আজ পর্যন্ত বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই। ব্যোমকেশ গলি দিয়ে খিড়কির দরজার দিকে যাইতে বলিল, ‘সদর আর খিড়কির দরজা ছাড়া বাড়ি থেকে পালাবার আর কোনো রাস্তা নেই? পাঁচিল ডিঙিয়ে পালানো যায় না?’
দারোগ বিজয়বাবু বলিলেন, ‘না।’
খিড়কির দরজায় একজন পাহারাওলা দাঁড়াইয়া আছে, উপরন্তু দরজায় তালা লাগানো। বিজয়বাবুর হুকুমে পাহারাওলা তালা খুলিয়া দিল, আমরা ভিতরে গেলাম।
ছোট্ট এক টুকরা উঠানের গায়ে দু’টি ঘর, পাশে রান্নাঘর ও স্নানের ঘর। ব্যোমকেশ বলিল, ‘বিজয়বাবু্, আপনি আর অজিত শান্তার কাছে গিয়ে বসুন, আমি স্নানের ঘর আর রান্নাঘর এক নজর দেখে যাই।’ বলিয়া সে পাশের দিকে চলিল।
আমরা সামনের ঘরে প্রবেশ করিলাম। এটি বসিবার ঘর। বেতের আসবাব দিয়া সাজানো। একটি বেতের চেয়ারে শান্তা উদাস অসহায়ভাবে বসিয়া আছে। চিন্তামণি কুণ্ডু তাহার চেহারার যে বৰ্ণনা দিয়াছিলেন তাহা সত্য; বর্তমানে তাহার মাথার চুলগুলি অবিন্যস্ত; চোখ দু’টিও ফুলোফুলো। বোধহয় কান্নাকাটি করিয়াছে।
আমরা ঘরে প্রবেশ করিলে সে মুখ তুলিল। আমাকে লক্ষ্যই করিল না, বিজয়বাবুর দিকে সপ্রশ্ন চক্ষে চাহিল। বিজয়বাবু কিছু বলিলেন না, একটা চেয়ারে উপবেশন করিলেন। আমিও বসিলাম।
তিনজনে নির্বাক বসিয়া আছি। আমি চিন্তা করিতেছি-পুলিসের জেরা শুনিয়া শুনিয়া মেয়েটা ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে। সে যদি নির্দোষ হয়, স্বামীর অপরাধের সহিত তাহার যদি কোনও সংযোগ না থাকে, তবু তাহার নিস্কৃতি নাই। কিন্তু তপন ওই লোকটাকে খুন করিল কেন? যৌন ঈর্ষা? শান্তার সঙ্গে ঐ লোকটার কি-?
ব্যোমকেশ শয়নকক্ষ হইতে প্রবেশ করিল; তাহার মুখ হাসি হাসি। সে শান্তার সম্মুখে চেয়ার টানিয়া বসিয়া স্মিতমুখে তাহার পানে চাহিয়া রহিল।
শান্তাও ক্লান্তভাবে তাহার পানে চাহিল, তারপর ধীরে ধীরে তাহার চোখে শঙ্কা ও সতর্কতা ফুটিয়া উঠিল। সে সোজা হইয়া বসিয়া একটু বিহুলভাবে বলিল, ‘কী—কী—?’
ব্যোমকেশ প্রফুল্ল স্বরে বলিল, ‘আপনার শোবার ঘরে একটা ছোট লোহার সিন্দুক রয়েছে দেখলাম। ওতে কী আছে?’
শাস্তা বলিল, ‘দারোগাবাবুকে তো বলেছি, কি আছে আমি জানি না। আমার স্বামী সিন্দুকের চাবি নিজের কাছে রাখতেন।’
বিজয়বাবু বলিলেন, ‘সিন্দুকের তালা ভাঙবার ব্যবস্থা করেছি।’
‘বেশ বেশ, ওতে অনেক মাল পাবেন; চোরাই মাল, দুপুরে ডাকাতির গয়নাপত্র।’–ব্যোমকেশ শান্তার দিকে ফিরিল, ‘আচ্ছা, বলুন দেখি, আপনার স্বামী কি দাড়ি কামাতেন না? বাড়িতে দাড়ি কামানোর সরঞ্জাম নেই।’
শান্তার মুখ ফ্যাকাসে হইয়া গিয়াছিল, সে অস্পষ্ট স্বরে বলিল, ‘তিনি সেলুনে দাড়ি কামাতেন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ও। আপনার স্বামী দেখছি অসামান্য লোক ছিলেন। তিনি সেলুনে দাড়ি কামাতেন, কিন্তু বাড়িতে চটি জুতো পরতেন না। কোনো কারণ ছিল কি?’
শান্তা চক্ষু নত করিয়া বলিল, ‘ওঁর চটি ছিঁড়ে গিয়েছিল, নতুন চটি কেনা হয়নি। যখন বাড়িতে থাকতেন। আমার চটি পরতেন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাই নাকি। আপনাদের দু’জনের পায়ের মাপ তাহলে সমান?’
শান্তা বলিল, ‘প্ৰায় সমান।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বাঃ! কত সুবিধে! আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর দেখছি প্ৰায় সবই সমান, কেবল চুলের রঙ আলাদা। চিন্তামণিবাবু জানিয়েছিলেন তপনের চুলের রঙ তামাটে। ঠিক তো?’