অদ্বিতীয়

শান্তা ঢোক গিলিয়া বলিল‌, ‘হ্যাঁ।’ বিজয়বাবু এতক্ষণ চোখ বাহির করিয়া প্রশ্নোত্তর শুনিতেছিলেন‌, হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া তীব্র উত্তেজনার কণ্ঠে বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু–!’

ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া বলিল‌, ‘দাঁড়ান। তৈরি থাকুন‌, এবার আমার শেষ প্রশ্ন।–শান্তা দেবি‌, চিন্তামণিবাবু দেখেছিলেন। আপনার গালে মসুরের মত লাল তিল আছে‌, সে তিলটা গেল কোথায়?’

শান্তা চকিতে নিজের বা গালে হাত দিল‌, তারপর সামলাইয়া লইয়া বলিল‌, ‘তিল! আমার গালে তো তিল নেই‌, চিন্তামণিবাবু ভুল দেখেছেন। হয়তো লাল কালির ছিটে লেগেছিল–’

ব্যোমকেশের মুখে হিংস্ব হাসি ফুটিয়া উঠিল‌, সে বলিল‌, ‘সব প্রশ্নেরই জবাব তৈরি করে রেখেছেন দেখছি। কিন্তু এ প্রশ্নের কি জবাব দেবেন।’ ক্ষিপ্রহস্তে সে শান্তার চুল ধরিয়া টান দিল, সঙ্গে সঙ্গে পরচুলা খসিয়া আসিল‌, ভিতর হইতে থাকেইটা তামাটে রঙের চুল বাহির হইয়া আসিল।

শান্তাও বিদ্যুৎবেগে জবাব দিল। একটু অবনত হইয়া সে নিজের ডান পা হইতে শাড়ির প্রান্ত তুলিল। পায়ের সঙ্গে রবারের গীটার দিয়া আটকানো ছিল একটা লিকলিকে ছুরি। ক্ষিপ্রহস্তে ছুরি মুষ্টিতে লইয়া শান্তা ব্যোমকেশের কণ্ঠ লক্ষ্য করিয়া ছুরি চালাইল। আমি ভয়ার্তা সম্মোহিতভাবে শুধু চাহিয়া রহিলাম; একটি স্ত্রীলোকের সুশ্ৰী কোমল মুখ যে চক্ষের নিমেষে। এমন কুশ্রী ও কঠিন হইয়া উঠিতে পারে তাহা কল্পনা করা যায় না।

দারোগা বিজয়বাবু যদি প্রস্তুত না থাকিতেন তাহা হইলে ব্যোমকেশের প্রাণ বাঁচিত কিনা সন্দেহ। তিনি বাঘের মত লাফাইয়া পড়িয়া শান্তার কজি ধরিয়া ফেলিলেন; ছুরি শান্তার মুষ্টি হইতে স্বলিত হইয়া মাটিতে পড়িল। সে বিষাক্ত চক্ষে ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া সৰ্প-তর্জনের মত নিশ্বাস ফেলিতে লাগিল।

ব্যোমকেশ হাসিমুখে উঠিয়া দাঁড়াইল‌, ‘বিজয়বাবু্‌, এই নিন। আপনার খুনী আসামী‌, আর এই নিন খুনের অস্ত্র!’

বিজয়বাবু একটু দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলিলেন‌, ‘কিন্তু চিন্তামণিবাবু বলেছিলেন তপন সেন–’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তপন সেনের অস্তিত্ব নেই‌, বিজয়বাবু। আছেন কেবল অদ্বিতীয় শান্তা সেন; ইনিই রাত্রে তপন সেন‌, দিনে শান্তা সে্ন-সাক্ষাৎ অর্ধনারীশ্বর মূর্তি। মহীয়সী মহিলা ইনি। ভাববেন না যে‌, বিধুভুষণ আইচকে খুন করাই এর একমাত্র কীর্তি। মাস দুই আগে ইনি বর্ধমান জেলের এক গার্ডকে খুন করে জেল থেকে পালিয়েছিলেন। এঁর আসল নাম আমার জানা নেই; আপনি পুলিসের লোক‌, ফেরারী কয়েদীর নাম জানতে পারেন।’

বিজয়বাবু শান্তার হাত বজ্রমুষ্টিতে ধরিয়া সুবর্তুল চোখে তাহার পানে চাহিয়া রহিলেন, চিবাইয়া চিবাইয়া বলিলেন‌, ‘প্রমীলা পাল। এবার সব বুঝেছি। স্বামীকে বিষ খাওয়ানোর জন্যে তোমার যাবজীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। দু’বছর জেল খাটবার পর তুমি জেলের গার্ডকে খুন করে পালিয়েছিলে। পালিয়ে এখানে এসে একাই স্বামী-স্ত্রী সেজে লুকিয়েছিলে। তারপর সে-রাত্রে বিধুভুষণ তোমাকে দেখতে পায়। বিধুভুষণ তোমাকে চিনতে পেরে তোমার পিছু নিয়েছিল। এইখানে বাড়ির সামনে এসে তুমি তাকে খুন করেছ।’ ব্যোমকেশের দিকে চক্ষু ফিরাইয়া বিজয়বাবু বলিলেন‌, ‘কেমন—এই তো?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘মোট কথা এই বটে।’

বিজয়বাবু হুঙ্কার ছাড়িলেন, ‘জমাদার।’

জমাদার ঘরের বাহিরেই ছিল‌, প্রবেশ করিল। বিজয়বাবু বলিলেন‌, ‘হাতকড়া লাগাঁও।’

চিন্তামণিবাবুর ঘরে বসিয়া চা পান করিতে করিতে ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনার চিঠি পড়ে খটকা লেগেছিল‌, চিন্তামণিবাবু। আপনি ওদের দু’জনকে একসঙ্গে কখনো দেখেননি‌, দূরবীন লাগিয়েও ওদের ব্যূহ ভেদ করতে পারেননি। কেন? পুরুষটা বেঁটে‌, মেয়েটা লম্বা; হরে দরে হাঁটু জল। ওরা সদর দরজা দিয়ে যাতায়াত করে না‌, খিড়কি দিয়ে আসে যায়; পুরুষটা চেরা-চেরা গলায় কথা বলে। কেন? সন্দেহ হয় যে কোথাও লুকোচুরি চলছে।

‘কিন্তু বেশি ফলাও করে সব কথা বলবার দরকার নেই। স্থূলভাবে ব্যাপারটা এই—জেল ভেঙে পালাবার পর প্রমীলা পালের দুটো জিনিস দরকার হয়েছিল; ছদ্মবেশ আর রোজগার। তার মাথার চুল তামাটে রঙের‌, সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে; তাই তাকে চুল ছেঁটে পুরুষ সাজতে হল। কিন্তু দুপুরে ডাকাতি করে রোজগার করার জন্য তার মেয়েমানুষ সাজা দরকার‌, তাই সে একটি সুন্দর বিলিতি পরচুলো যোগাড় করল। কোথায় চুল ছেটেছিল‌, কোথা থেকে পরচুলো যোগাড় করল আমি জানি না; কিন্তু তার দ্বৈত-জীবন আরম্ভ হল। এখন শীতকাল চলছে‌, স্ত্রীলোকের পক্ষে পুরুষ সাজার খুব সুবিধা। সে নাকের নীচে একটি ছোট্ট প্রজাপতি-গোঁফ লাগালো‌, গায়ে কোট-প্যান্টের ওপর ওভারকেট চড়ালো‌, তারপর আপনার কাছে বাড়ি ভুগড়া নিতে এল; পাছে মেয়েলি গলা ধরা পড়ে। তাই আপনার সঙ্গে চেরা-চেরা গলায় কথা কইল। কলকাতা শহরে ছদ্মবেশে থাকার খুব সুবিধা‌, পাড়াপাড়শী কেউ কারুর খবর রাখে না। কিন্তু সে লক্ষ্য করল। আপনি সারাক্ষণ জানালার কাছে বসে থাকেন‌, আপনার বাইনোকুলার আছে। তাকে সাবধান থাকতে হবে।

‘সে-রত্রে আপনি শুয়ে পড়বার পর সে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ি দখল করতে এল। কেউ জানতে পারল না যে মাত্র একজন লোক এসেছে‌, দু’জন নয়। তার সঙ্গে একটা ছোট্ট লোহার সিন্দুক ছিল‌, সেটা সে শোবার ঘরে রাখল।

‘তারপর তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রা আরম্ভ হল। সকালবেলা সে স্কুলে পড়বার নাম করে বেরিয়ে যায়‌, দুপুরবেলা ‘দুপুর ডাকাতি করার মতলবে ঘুরে বেড়ায়‌, বিকেলবেলা ফিরে আসে। আবার সন্ধ্যের পর পুরুষ সেজে বেরোয় আপনাকে ধাপ্পা দেবার জন্যে। ঘরের বিদ্যুৎবাতি নিবিয়ে পিদিম জ্বেলে রেখে বেরোয়; তেল ফুরোলে পিদিম নিবে যায়‌, আপনি ভাকেন শান্তা আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ল। আপনি কেবল একটা ভুল করেছিলেন; ইলেকট্রিক বাতি যে তপন বাড়ি থেকে বেরুবার আগে নেবে সেটা লক্ষ্য করেননি। আপনার মনে সন্দেহ ছিল না। তাই লক্ষ্য করেননি।

0 Shares