শুনিতে শুনিতে ব্যোমকেশের দৃষ্টি প্রখর হইয়া উঠিয়ছিল; সে বলিল, ‘কতদিন আগের কথা?’
‘দু-তিন মাস হবে।’
‘প্রাণকেষ্টবাবু প্রায়ই এ-লাইনে যাতায়াত করেন! শেষ কবে এসেছিলেন?’
‘চার-পাঁচ দিন আগে। স্টেশনে বেশিক্ষণ ছিলেন না, ট্রলিতে চড়ে লাইন দেখতে চলে গেলেন।’
‘শালা-ভগিনীপতির মধ্যে বেশ সত্ত্বাব ছিল?’
‘ভেতরে কি ছিল জানি না, বাইরে সদ্ভাব ছিল।’
‘যাক। তারপর থেকে সদানন্দ সুর আপনার কাছে যাতায়াত করতেন? কী উপলক্ষে যাতায়তা করতেন?’
হরবিলাসবাবু আবার কিছুক্ষণ নীরবে চিত্তা মন্থন করিয়া বলিলেন, ‘সদানন্দবাবু দালাল ছিলেন, ছোটখাট জিনিসের দালালি করতেন। আমার ডিস্পেপসিয়া আছে দেখে তিনি আমাকে কবিরাজী চিকিৎসা করাবার জন্য ভজচ্ছিলেন। দু’এক শিশি গছিয়েছিলেন; হত্তুকী আর বিটনুন। তাতে কিছু হল না।’
হরি হরি, শেষে, হরীতকী আর বিটলুন! ব্যোমকেশ তবু প্রশ্ন করিল, ‘এ ছাড়া সদানন্দ সুরের সঙ্গে আপনার আর কোনও সম্বন্ধ ছিল না?’
‘না।’
নিশ্বাস ছাড়িয়া ব্যোমকেশ উঠিয়া পড়িল, ‘আপনাকে অনর্থক কষ্ট দিলাম। প্রাণকেষ্টবাবু এখন রামডিহি জংশনেই আছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘নমস্কার।–চল, অজিত।’
স্টেশনের বাহিরে আসিয়া বলিলাম, ‘এবার কী?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ওবেলা রামডিহিতে গিয়ে প্রাণকেষ্ট পাল মহাশয়কে দর্শন করে আসতে হবে। তিনি শ্যালকের মৃত্যু-সংবাদ যদি বা এখনও না পেয়ে থাকেন, বিকেল নাগাদ নিশ্চয় পাবেন।–হরিবিলাসবাবুকে কেমন মনে হল?’
বলিলাম, ‘আকার-সদৃশী প্রজ্ঞা। যেমন ঘুণ-ধরা চেহারা, তেমনি মরচে-ধরা বুদ্ধি। শূন্য সিন্দুকে ডবল তালা। তুমি যদি সন্দেহ করে থাকো যে উনি লুকিয়ে লুকিয়ে গোলা-বারুদের কালাবাজার করছেন, তাহলে ও-সন্দেহ ত্যাগ করতে পার। হরিবিলাসবাবুর একমাত্র গোলা হচ্ছে হরীতকী-খণ্ড, আর বারুদ-বিটলুন।’
ব্যোমকেশ হাসিল; বলিল, ‘চল, বাজারটা ঘুরে আসা যাক।’
‘বাজারে কী দরকার?’
‘এসই না।’
গঞ্জের কর্মব্যস্ততা আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। প্রত্যেক আড়াতের সামনে মুক্তস্থানে বহু গরুর গাড়ির ঠেলাঠেলি, দুই-চারিটা ঘোড়ায়-টানা খোলা ট্রাক-জাতীয় গাড়িও আছে। প্রত্যেক গোলা হইতে ‘রামে রাম দুইয়ে দুই শব্দ উঠিতেছে। ডাই-করা কাঁচা-মাল পাঁচসেরি বাটখারায় ওজন হইতেছে।
একটি গোলায় এক বাঙালী যুবক দাঁড়াইয়া কাজকর্ম তদারক করিতেছিলেন, ব্যোমকেশ গিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘এটা নফার কুণ্ডু মশায়ের গোলা না?’
ছোকরা বোধ হয় ব্যোমকেশের মুখ চিনিত, সসম্রামে বলিল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি তাঁর ভাইপো।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বেশ বেশ। কুণ্ডুমশাই কোথায়?’
ছোকরা বলিল, ‘আজ্ঞে, কাকা এখানে নেই, বাইরে গেছেন। কিছু দরকার আছে কি?’
‘দরকার এমন কিছু নয়। কোথায় গেছেন?’
‘আজ্ঞে, তা কিছু বলে যাননি।’
‘তাই নাকি! কবে গেছেন?’
‘গত মঙ্গলবার বিকেলবেলা।’
ব্যোমকেশ আড়চোখে আমার পানে চাহিল। আমার মনে পড়িয়া গেল, গত সোমবারে আমি রামডিহি স্টেশনে গিয়া বেনামী চিঠি ডাকে দিয়া আসিয়াছিলাম। স্বাভাবিক নিয়মে চিঠি মঙ্গলবারে এখানে পৌঁছিয়াছে। নফর কুণ্ডুর নামেও একটি বেনামী চিঠি ছিল। তবে কি চিঠি পাইয়া পাখি উড়িয়াছে? নফর কুণ্ডুই আমাদের অচিন পাখি? কিন্তু সে যাই হোক, ভাইপো ছোকরা কিছু জানে বলিয়া মনে হয় না; সরলভাবে সব কথার উত্তর দিতেছে।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তিনি কবে ফিরবেন তাও বোধ হয় জানা নেই?’
‘আজ্ঞে না, কিছু বলে যাননি।’
ব্যোমকেশ একটু চিন্তা করিয়া বলিল, ‘আচ্ছা, যেদিন নফরবাবু চলে যান সেদিন সকালে কি কোনও চিঠিপত্র পেয়েছিলেন?’
ছোকরা বলিল, ‘চিঠি রোজই দু’চারখানা আসে, সেদিনও এসেছিল।’
‘হুঁ।’
প্রস্থনোদ্যত হইয়া ব্যোমকেশ আবার ঘুরিয়া দাঁড়াইল, ‘তোমাদের কোটা ঘোড়া আছে?’
ছোকরা অবাক হইয়া চাহিল, ‘ঘোড়া!’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ঘোড়া। ওই যে ট্রাক টানে।’ ব্যোমকেশ আঙ্গুল দিয়া পাশের গোলা দেখাইল।
যুবক বুঝিয়া বলিল, ‘ও-না, আমাদের ঘোড়া-টানা ট্রাক নেই, গরুর গাড়িতে চলে যায়।’ এই সময় এক ইউনিফর্ম-পরা কনস্টেবল আসিয়া জোড়পায়ে দাঁড়াইয়া ব্যোমকেশকে স্যালুট করিল, ‘হুজুর, দারোগাসাহেব সেলাম দিয়া হ্যায়।’
ব্যোমকেশ ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া চাহিল; বলিল, ‘চল, যাচ্ছি।’
৬
কাছেই থানা। সেই দিকে যাইতে যাইতে ব্যোমকেশ বলিল, ‘সুখময় দারোগা কি রকম ফিচেল দেখেছ? হাটের মাঝখানে কনস্টেবল পাঠিয়েছে, যাতে কারুর জানতে বাকি না থাকে যে পুলিসের সঙ্গে আমার ভারি দহরম মহরম।’
‘হুঁ। কিন্তু তলব কিসের জন্যে?’
‘বোধ হয় অমৃতের পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট এসেছে।’
থানায় পদাৰ্পণ করিতেই সুখময় দারোগা মুখে মধুর রসের ফোয়ারা ছুটাইয়া দিলেন, ‘আসুন, আসুন ব্যোমকেশবাবু্, আসুন অজিতবাবু্, বসুন বসুন। ব্যোমকেশবাবু্, আপনি এই চেয়ারটাতে বসুন। আমি আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম, হঠাৎ নজরে পড়ল আপনারা এদিকে আসছেন। হে-হে, এই নিন অমৃতের পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট। বুদ্ধি বটে আপনার; ঠিক ধরেছিলেন, বন্দুকের গুলিতেই মরেছে।’ বলিয়া ডাক্তারের রিপোর্ট ব্যোমকেশের হাতে দিলেন।
বিচিত্র জীব এই সুখময়বাবু। এইরূপ চরিত্র আমরা সকলেই দেখিয়াছি এবং মনে মনে সহিংস তারিফ করিয়াছি। কিন্তু ভালবাসিতে পারি নাই। ইহারা কেবল পুলিস-বিভাগে নয়, জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই ছড়াইয়া আছেন।
রিপোর্ট পড়িয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘গুলিটা শরীরের মধ্যেই পাওয়া গিয়েছে দেখছি। কোথায় সেটা?’