অমৃতের মৃত্যু

‘এই যে!’ একটা নম্বর-আঁটা টিনের কোটা হইতে মাষকলাইয়ের মত একটি সীসার টুকরা লইয়া সুখময়বাবু তাহার হাতে দিলেন।

করতলে গুলিটি রাখিয়া ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ সেটিকে সমীক্ষণ করিল‌, তারপর সুখময়বাবুকে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘এ থেকে কিছু বুঝলেন?’

সুখময়বাবু বলিলেন‌, ‘আজ্ঞে‌, গুলি দেখে বোঝা যাচ্ছে পিস্তল কিংবা রিভলবারের গুলি। এ ছাড়া বোঝবার আর কিছু আছে কি?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আছে বৈকি। গুলি থেকে বোঝা যাচ্ছে–.৩৮ অটোম্যাটিক থেকে গুলি বেরিয়েছে‌, যে .৩৮ অটোম্যাটিক যুদ্ধের সময় মার্কিন সৈন্য ব্যবহার করত। অৰ্থাৎ–’ ব্যোমকেশ থামিল।

সুখময়বাবু বলিলেন‌, ‘অৰ্থাৎ অমৃতকে যে খুন করেছে এবং আপনি যাকে খুঁজতে এসেছেন তাদের মধ্যে যোগাযোগ আছে‌, এমন কি তারা একই লোক হতে পারে। কেমন?’

ব্যোমকেশ গুলিটি তাঁহাকে ফেরত দিয়া বলিল‌, ‘এ বিষয়ে আমার কিছু না বলাই ভালো। আপনার কাজ অমৃতের হত্যাকারীকে ধরা‌, সে-কাজ আপনি করবেন। আমার কাজ অন্য।’

‘তা তো বটেই‌, তা তো বটেই। হ্যাঁ ভালো কথা‌, সদানন্দ সুরের লাশ হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছি‌, রিপোর্ট এলেই আপনাকে দেখাব।’

‘আমাকে সদানন্দ সুরের রিপোর্ট দেখানোর দরকার নেই। এটাও আপনারই কেস‌, আমি হস্তক্ষেপ করতে চাই না। আমি রুই-কাতলা ধরতে এসেছি‌, চুনাপুটিতে আমার দরকার কি বলুন।’

সুখময়বাবুর চক্ষু দু’টি ধূর্ত কৌতুকে ভরিয়া উঠিল‌, তিনি বলিলেন‌, ‘সে-কথা একশো বার। কিন্তু ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনার জালে যখন রুই-কাতলা উঠবে তখন আমার চুনাপুটিও সেই জালেই উঠবে; আমাকে আলাদা জাল ফেলতে হবে না। হে হে হে হে। চললেন নাকি? আচ্ছা‌, নমস্কার।’

বাহিরে আসিলাম। ব্যোমকেশ আমার পানে চাহিয়া হাসিয়া ফেলিল। লোকটার দুষ্টবুদ্ধির শেষ নাই‌, অথচ তাহার কার্যকলাপে না হাসিয়াও থাকা যায় না। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এখনও রোদ চড়েনি‌, চলো চালের কল দুটো দেখে যাই।’

রাস্তা দিয়া ঘুরিয়া বিশ্বনাথ রাইস মিল-এর সম্মুখে উপস্থিত হইতে পাঁচ মিনিট লাগিল। বেশ বড় চালের কল‌, পাঁচ-ছয় বিঘা জমির উপর প্রসারিত; কাঁটা-তারের বেড়া দিয়া ঘেরা। গুখািরক্ষিত ফটক দিয়া প্রবেশ করিলে প্রথমেই সামনে প্রকাণ্ড শান-বাঁধানো চাতাল চোখে পড়ে। চাতালের ওপারে একটি পুকুর‌, বাঁ পাশে ইঞ্জিন-ঘর ও ধান-ভানার করোগেটের ছাউনি; ডান পাশে গুদাম‌, দপ্তর ও মালিকের থাকিবার জন্য একসারি কক্ষ। সকালবেলা কাজ চালু আছে, সধান-ভানার ছাউনী হইতে ছড়্‌ ছড়্‌ ছর্‌ছর্‌ শব্দ আসিতেছে। কুলি-মজুরেরা কাজে ব্যস্ত, গরুর গাড়ি ও ঘোড়ার ট্রাক হইতে বস্তা ওঠা-নমা হইতেছে।

চাল কলের মালিকের নাম বিশ্বনাথ মল্লিক। থানা হইতে তাঁহার নাম সংগ্রহ করিলেও এবং বেনামী চিঠি পাঠাইলেও চাক্ষুষ পরিচয় এখনও হয় নাই। আমরা গুখ্যার মারফত এত্তালা পাঠাইয়া মিল-এ প্রবেশ করিলাম। দপ্তরে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম বিশ্বনাথবাবু সেখানে নাই‌, একজন মুহুরী গোছের লোক গদিতে বসিয়া খাতপত্র লিখিতেছে।

‘কী চান?’

‘বিশ্বনাথবাবু আছেন? আমরা পুলিসের পক্ষ থেকে আসছি।’

লোকটি তটস্থ হইয়া উঠিল‌, ‘আসুন আসুন‌, বসতে আজ্ঞা হোক। কত মিল-এর কাজ তদারক করতে গেছেন‌, এখনি আসবেন। তাঁকে খবর পাঠাব কি?’

ঘরের অর্ধেক মেঝে জুড়িয়া গদির বিছানা‌, আমরা গদির উপর উপবেশন করিলাম। সত্য কথা বলিতে কি‌, আধুনিক চেয়ার-সোফার চেয়ে সাবেক গন্দি-ফরাশ ঢের বেশি আরামের।‌্‌, ব্যোমকেশ একটি সুপুষ্ট তাকিয়া কোলের কাছে টানিয়া লইয়া বলিল‌, ‘না না‌, তাঁকে ডেকে পাঠানোর দরকার নেই। সামান্য দু-চারটে কথা জিজ্ঞেস করার আছে‌, তা সে আপনিই বলতে পারবেন। আপনি বুঝি মিল-এর হিসেব রাখেন?’

লোকটি সবিনয়ে হস্তঘর্ষণ করিয়া বলিল‌, ‘আজ্ঞে‌, আমি মিল-এর নায়েব-সরকার। অধীনের নাম নীলকণ্ঠ অধিকারী। আপনি কি ব্যোমকেশ বক্সী মশাই?’

ব্যোমকেশ হাসিয়া ঘাড় নাড়িল। নীলকণ্ঠ অধিকারী ভক্তি-তদগত চক্ষে তাহার পানে চাহিয়া রহিল। এমন লোক আছে পুলিসের নাম শুনিলে যাহাদের হৃদয় বিগলিত হয়। উপরন্তু তাহারা যদি ব্যোমকেশ বক্সীর নাম শুনিতে পায় তাহা হইলে তাঁহাদের হৃদয়াবেগ বাঁধ-ভাঙা বন্যার মত দু’কুল ছাপাইয়া প্রবাহিত হইতে থাকে‌, তখন আর তাহাদের ঠেকাইয়া রাখা যায় না। নীলকণ্ঠ অধিকারী সেই জাতীয় লোক। তাহার মুখ দেখিয়া বুঝিলাম‌, ব্যোমকেশকে আদেয় তাহার কিছুই নাই; প্রশ্নের উত্তর সে দিবেই‌, এমন কি‌, প্রশ্ন না করিলেও সে উত্তর দিবে।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনাকে দেখে কাজের লোক মনে হচ্ছে। মিল-এর সব কাজ আপনিই দেখেন?’

নীলকণ্ঠ সহৰ্ষে হস্তঘর্ষণ করিল‌, ‘আজ্ঞে‌, কতাও দেখেন। উনি যখন থাকেন না। তখন আমার ওপরেই সব ভার পড়ে।’

‘কর্তা-মানে বিশ্বনাথবাবু-এখানে থাকেন না?’

‘আজ্ঞে‌, এখানেই থাকেন। তবে মিল-এর কাজকর্ম যখন কম থাকে তখন দু’চার দিনের জন্য কলকাতা যান। কলকাতায় কর্তার ফ্যামিলি থাকেন।’

‘বুঝেছি। তা কর্তা কতদিন কলকাতা যাননি?’

‘মাসখানেক হবে। এখন কাজের চাপ বেশি—’

‘আচ্ছা‌, ও-কথা থাক। অমৃত নামে বাঘমারি গ্রামের একটি ছোকরা সম্প্রতি মারা গেছে তাকে আপনি চিনতেন?’

নীলকণ্ঠ উৎসুক স্বরে বলিল‌, ‘চিনতাম বৈকি। অমৃত প্রায়ই কর্তার কাছে চাকরির জন্য দরবার করতে আসত। কিন্তু

‘সদানন্দ সুরকেও আপনি চিনতেন?

নীলকণ্ঠ সংহত স্বরে বলিল‌, ‘সদানন্দবাবু কাল রাত্রে বোমা ফেটে মারা গেছেন‌, আজ সকালে খবর পেয়েছি। সদানন্দবাবুকে ভালোরকম চিনতাম। আমাদের এখানে তাঁর খুব যাতায়াত छिब्ल। ‘

0 Shares