অমৃতের মৃত্যু

‘কী উপলক্ষে যাতায়াত ছিল?’

‘উপলক্ষ-কর্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। মাঝে মাঝে গদিতে এসে বসতেন‌, তামাক খেতেন‌, কর্তার সঙ্গে দুদণ্ড বসে গল্পগাছা করতেন। এর বেশি উপলক্ষ কিছু ছিল না। তবে—’ বলিয়া নীলকণ্ঠ থামিল।

‘অর্থাৎ মোসায়েবি করতেন। তবে কি?’

‘দিন দশেক আগে তিনি কর্তার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করেছিলেন।’

‘তাই নাকি! কত টাকা?’

‘পাঁচশো।’

‘হ্যান্ডনোট লিখে টাকা ধার নিয়েছিলেন?’

‘আজ্ঞে না। কত সদানন্দবাবুকে বিশ্বাস করতেন‌, বহিখাতায় সদানন্দবাবুর নামে পাঁচশো টাকা কৰ্ম্ম লিখে টাকা দেওয়া হয়েছিল। টাকাটা বোধহয় ডুবল।’ বলিয়া নীলকণ্ঠ দুঃখিতভাবে মাথা নাড়িল।

ব্যোমকেশ গালে হাত দিয়া ভাবিতে লাগিল। কি ভাবিল জানি না‌, কিন্তু খানিক পরে বাহির হইতে ঘোড়ার চিহি-চিহি শব্দ শুনিয়া তাহার চমক ভাঙিল। সে মুখ তুলিয়া বলিল‌, ‘ভালো কথা‌, অনেকগুলো ঘোড়া দেখলাম। সবগুলোই কি আপনাদের?

নীলকণ্ঠ সোৎসাহে বলিল‌, ‘আজ্ঞে‌, সব আমাদের। কর্তার খুব ঘোড়ার শখ। নটা ঘোড়া আছে।’

‘তাই নাকি! এতগুলো ঘোড়া কি করে? ট্রাক টানে?’

‘ট্রাক তো টানেই। তা ছাড়া কর্তা  নিজে ঘোড়ায় চড়তে ভালবাসেন। উনি কমবয়সে জকি ছিলেন। কিনা—‘

‘নীলকণ্ঠ!—‘

শব্দটা আমাদের পিছন দিক হইতে চাবুকের মত আসিয়া নীলকণ্ঠের মুখে পড়িল। নীলকণ্ঠ ভীতমুখে চুপ করিল‌, আমরা একসঙ্গে পিছনে ঘাড় ফিরাইলাম।

দ্বারের সম্মুখে একটি লোক দাঁড়াইয়া আছে। বয়স আন্দাজ চল্লিশ‌, ক্ষীণ-খর্ব চেহারা‌, অস্থিসার মুখে বড় বড় চোখ‌, হাফ-প্যান্ট ও হাফ-শার্ট পরা শরীরে বিকলতা কিছু না থাকিলেও‌, জঙ্ঘার হাড়-দু’টি ধনুকের মতো বাঁকা। ইনিই যে মিল-এর মালিক ভূতপূর্ব জকি বিশ্বনাথ মল্লিক তাহা নিঃসংশয়ে বুঝিতে পারিলাম।

বিশ্বনাথ মল্লিক নীলকণ্ঠের দিকেই চাহিয়া ছিলেন‌, পলকের জন্যও আমাদের দিকে চক্ষু ফিরান নাই। এখন তিনি ঘরের মধ্যে দুই পা অগ্রসর হইয়া আগের মতাই শাণিত কণ্ঠে নীলকণ্ঠকে বলিলেন‌, ‘ইস্টিশানে মাল চালান যাচ্ছে‌, তুমি তদারক করো গিয়ে।’

নীলকণ্ঠ কশাহত ঘোড়ার মত ছুটিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

এইবার বিশ্বনাথ মল্লিক আমাদের দিকে চক্ষু ফিরাইলেন। তাঁহার মুখ হইতে মালিক-সুলভ কঠোরতা অপগত হইয়া একটু হাসির আভাস দেখা দিল। তিনি সহজ সুরে বলিলেন‌, ‘নীলকণ্ঠ বড় বেশি কথা কয়। আমি আগে জকি ছিলাম‌, সেই খবর আপনাদের শোনাচ্ছিল বুঝি?’

ব্যোমকেশ একটু অপ্রস্তুত হইয়া বলিল‌, ‘ঘোড়ার কথা থেকে জকির কথা উঠে পড়ল।’

বিশ্বনাথবাবু মুখে সহাস্য ভঙ্গী করিলেন‌, ‘নিজের লজ্জাকর অতীতের কথা সবাই চাপা দিতে চায়‌, আমার কিন্তু লজ্জা নেই। ববং দুঃখ আছে‌, যদি জকির কাজ ছেড়ে না দিতাম‌, এতদিনে হয়তো খীম সিং কি খাদে হয়ে দাঁড়াতাম। কিন্তু ও-কথা যাক। আপনি ব্যোমকেশবাবু—না? সদানন্দ সুরের মৃত্যু সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতে এসেছেন? আসুন‌, আমার বসবার ঘরে যাওয়া যাক।’

বিশু মল্লিকের খাস কামরাটি আধুনিক প্রথায় টেবিল চেয়ার দিয়া সাজানো‌, বেশ ফিটফাট। আমরা উপবেশন করিলে তিনি টেবিলের দেরাজ হইতে সিগারেটের টিন বাহির করিয়া দিলেন।

বিশু মল্লিকের চেহারাটি অকিঞ্চিৎকর বটে‌, কিন্তু তাঁহার আচার-ব্যবহারে বেশ একটি আত্মপ্রত্যয়শীল ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়‌, চোখ দু’টির অন্তরালে সজাগ শক্তিশালী মস্তিষ্কের ক্রিয়া চলিতেছে তাহাও বুঝিতে কষ্ট হয় না। আমাদের সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করিয়া তিনি নিজে সিগারেট ধরাইলেন। টেবিলের সামনের দিকে বসিয়া বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনি কি জন্যে সান্তালগোলায় এসেছেন তা আমি জানি। বোধহয় এখানকার সকলেই জানে। এখন বলুন আমি কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি। অবশ্য নীলকণ্ঠের কাছে আমার সম্বন্ধে সব কথাই শুনেছেন। যদি আমাকেই গোলাবারুদের আসামী বলে সন্দেহ করেন তাহলে আমার মিল খুঁজে দেখতে পারেন‌, আমার কোনও আপত্তি নেই।’

ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল‌, ‘খোঁজাখুঁজির কথা পরে হবে। এখন আমার একটি ব্যক্তিগত কৌতুহল চরিতার্থকরুন। জকির কাজ ছেড়ে চালের কল করলেন কেন? যতদূর জানি জকির কাজে পয়সা আছে।’

বিশুবাবু বলিলেন‌, ‘পয়সা অবশ্য আছে কিন্তু বড় কড়াকড়ির জীবন‌, ব্যোমকেশবাবু। কখন ওজন বেড়ে যাবে এই ভয়ে আধ-পেটা খেয়ে জীবন কাটাতে হয়। আরও অনেক বায়নাক্কা আছে। আমার পোষাল না। কিছু টাকা জমিয়েছিলাম‌, তাই দিয়ে যুদ্ধের আগে এই মিল খুলে বসলাম। তা‌, বলতে নেই‌, মন্দ চলছে না।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কিন্তু ঘোড়ার মোহ ছাড়তে পারলেন না। এখানেও অনেকগুলি ঘোড়া পুষেছেন দেখলাম।’

বিশুবাবু ঈষৎ গাঢ়স্বরে বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ। আমি ঘোড়া ভালবাসি। অমন বুদ্ধিমান প্রভুভক্ত জানোয়ার আর নেই। মানুষের প্রকৃত বন্ধু যদি কেউ থাকে সে কুকুর নয়‌, ঘোড়া।’

‘তা বটে।’ ব্যোমকেশ চিন্তা করিতে করিতে বলিল‌, ‘আমারও কুকুরের চেয়ে ঘোড়া ভাল লাগে। কত রঙের ঘোড়াই আছে; লাল সাদা কালো। তবে এদেশে লাল ঘোড়াই বেশি দেখা যায়‌, সাদা কালো তত বেশি নয়। এই দেখুন না‌, সান্তালগোলাতেই কত ঘোড়া চোখে পড়ল‌, কিন্তু সাদা বা কালো ঘোড়া একটাও দেখলাম না।’

বিশুবাবু বলিলেন‌, ‘আপনি ঠিক বলেছেন। সাদা ঘোড়া এখানে একটাও নেই। তবে একটা কালো ঘোড়া আছে। বদ্রিদাস মাড়োয়ারীর।’

‘বদ্রিদাস-সে কে?’

‘এখানে আর-একটা চালের কল আছে‌, তার মালিক বদ্রিদাস গিরধরলাল। তার কয়েকটা ঘোড়া আছে‌, তাদের মধ্যে একটা ঘোড়া কালো।’

0 Shares