অমৃতের মৃত্যু

ব্যোমকেশ সিগারেটের শেষাংশ অ্যাশ-ট্রেতে ঘসিয়া নিভাইয়া দিল। ঘোড়া সম্বন্ধে তাহার কৌতুহল নিবৃত্ত হইয়াছে এমনি নিরুৎসুক স্বরে বলিল‌, ‘কালো ঘোড়া আছে তাহলে। —যাক‌, এবার কাজের কথা বলি। আপনার কর্মচারীর কাছে কিছু খবর পেয়েছি‌, সে-সব কথা আবার জিজ্ঞেস করে সময় নষ্ট করব না। সদানন্দ সুরের মৃত্যু-সংবাদ আপনি পেয়েছেন। ঘটনাক্রমে আমি তখন বাঘমারি গ্রামে ছিলাম। ভয়াবহ মৃত্যু।’

বিশুবাবু বলিলেন‌, ‘শুনেছি বোমা ফেটে মৃত্যু হয়েছে। আপনি দেখেছিলেন?’

ব্যোমকেশ সংক্ষেপে মৃত্যুর বিবরণ দিয়া বলিল‌, ‘এখন শুধু সদানন্দ সুরের মৃত্যুর কিনারা নয়‌, বোমারও কিনারা করতে হবে। আপনি বুদ্ধিমান লোক‌, এবিষয়ে আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করতে পারেন।’

‘কিভাবে সাহায্য করতে পারি বলুন।’

‘আপনি এখানে অনেক দিন আছেন‌, এখানকার ঘাঁৎঘোঁৎ জানা আছে। মার্কিন সিপাহীর দল যখন এখানে ছিল‌, তখন আপনিও ছিলেন। আপনি বলতে পারেন। কারা মার্কিন সিপাহীদের ছাউনিতে যাতায়াত করত?’

বিশুবাবু কিছুক্ষণ নতনেত্ৰে চিন্তা করিয়া বলিলেন‌, ‘মার্কিন সিপাহীদের ছাউনিতে কারুর যাতায়াত ছিল। কিনা আমি বলতে পারি না‌, কিন্তু তাদের সর্বত্র যাতায়াত ছিল। ভারি মিশুক লোক ছিল তারা‌, আমার মিল-এও অনেকবার এসেছে।’

‘হুঁ। তারা আপনার কাছে অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করবার চেষ্টা করেছিল কি?’

বিশুবাবু একটু গভীর হাসিলেন‌, ‘করেছিল। একজন সার্জেণ্ট একটা পিস্তল বিক্রি করবার চেষ্টা করেছিল। আমি কিনিনি।’

‘আপনি কেনেননি‌, আর কেউ কিনেছিল। প্রশ্ন হচ্ছে‌, লোকটা কে। আপনি কিছু আন্দাজ করতে পারেন?’

‘কিছু না। আন্দাজ করতে পারলে অনেক আগেই আপনাদের খবর দিতাম‌, ব্যোমকেশবাবু।’

ব্যোমকেশ আর একটা সিগারেট ধরাইয়া কিছুক্ষণ নীরবে টানিল‌, ‘আচ্ছা‌, আর একটা কথা। সান্তালগোলা ছোট জায়গা‌, এখানে মারণাস্ত্রগুলো যদি কেউ লুকিয়ে রাখতে চায় তাহলে কোথায় লুকিয়ে রাখবে আপনি অনুমান করতে পারেন?’

বিশুবাবু আবার কিছুক্ষণ চক্ষু নত করিয়া চিন্তা করিলেন‌, শেষে বলিলেন‌, ‘আপনার বিশ্বাস মারণাস্ত্রগুলো সান্তালগোলাতেই আছে। কিন্তু তা নাও হতে পারে।’

‘মনে করুন। সান্তালগোলাতেই আছে।’

‘বেশ‌, মনে করলাম। কিন্তু অস্ত্রগুলোর আয়তন কতখানি‌, কাঁটা বন্দুক কটা বোমা‌, এসব তো কিছুই জানি না। কি করে আনুমান করব? আমার মনে হয় পুলিস যদি সান্তালগোলার সমস্ত বাড়ি‌, সমস্ত গোলা আর চালের কল একসঙ্গে খানাতল্লাশ করে তাহলে হয়তো অস্ত্রগুলো বেরুতে পারে।’

ব্যোমকেশ মাথা নাড়িল‌, ‘তা কি সম্ভব! আর যদি সম্ভব হত তাহলেও একটা কথা ভেবে দেখুন। যে-ব্যক্তি এই কাজ করছে সে নিবেধি নয়‌, সে কি এমন জায়গায় মাল রাখবে যেখানে পুলিস সহজেই খুঁজে বার করতে পারে? আমার তা মনে হয় না। লোকটি যদি এত নিবোধ হত তাহলে অনেক আগেই ধরা পড়ে যেত।’

বিশুবাবু উৎসুক স্বরে বলিলেন‌, ‘তাহলে আপনার কী মনে হয়? কোথায় লুকিয়ে রাখতে পারে?’

ব্যোমকেশ খানিক চুপ করিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিল‌, ‘এমন জায়গায় রেখেছে যেখানে কারুর যেতে মানা নেই‌, অথচ কেউ যায় না‌, যেখানে দৈবাৎ মাল পাওয়া গেলেও প্রমাণ করা যাবে না কে রেখেছে?’

বিশুবাবু চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিলেন‌, ‘অৰ্থাৎ—?’

ব্যোমকেশ পিছনের খোলা জানলা দিয়া অঙ্গুলি নির্দেশ করিল‌, ‘অৰ্থাৎ ওই জঙ্গল। ওখানে ঝোপঝাড়ের মধ্যে কয়েকটা পিস্তল আর হ্যান্ড-গ্রিনেড পুতে রাখা খুব শক্ত কাজ নয়‌, কিন্তু খুঁজে বার করা অসম্ভব। যদি বা খুঁজে বার করলেন‌, কে পুতেছে কি করে প্রমাণ করবেন?’

বিশুবাবু উৎসাহভরে বলিয়া উঠিলেন‌, ‘ঠিক‌, ঠিক। জঙ্গলের কথাটা আমার মাথায় আসেনি। নিশ্চয় জঙ্গলে কোথাও পোঁতা আছে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘অবশ্য আমার ভুলও হতে পারে। কিন্তু ভুল হয়েছে কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখা দরকার।’

বিশুবাবু বলিলেন‌, ‘না ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমার বিশ্বাস আর দেরি না করে জঙ্গলটা খুঁজে দেখা দরকার।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তাই করতে হবে। তবে জঙ্গল তো একটুখানি জায়গা নয়‌, খুঁজতে সময় লাগবে। অনেক লোকও লাগবে। আজ আর হবে না‌, কাল—’

এই পর্যন্ত বলিয়া ব্যোমকেশ থামিয়া গেল। এতক্ষণ সে অসতর্কভাবে কথা বলিতেছিল‌, এখন যেন রাশ টানিয়া নিজেকে সংযত করিল; বিশুবাবুর পানে তীক্ষ্ণভাবে ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিয়া বলিল‌, ‘বিশ্বনাথবাবু্‌, আজ। আপনাকে বিশ্বাস করে এমন কথা কিছু বললাম। যা বাইরের লোকের কাছে বক্তব্য নয়। আপনি বিশ্বাসযোগ্য লোক বলেই বলেছি। আশা করি আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবেন।’

বিশ্বনাথবাবু বলিলেন‌, ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন‌, আমার মুখ থেকে কোনো কথা বেরুবে না। উঠছেন নাকি?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হ্যাঁ‌, আজ উঠি। একবার ঐ মাড়োয়ারী-কি নাম?-বদ্রিদাসের মিল-এ যাব। দেখি যদি ওর কাছে কিছু খবর পাওয়া যায়। বিকেলে আবার রামডিহি যেতে হবে‌, সেখানে সদানন্দ সুরের ভগিনীপতি থাকেন। —আচ্ছা‌, সদানন্দবাবু যে আপনার কাছে পাঁচশো টাকা ধার নিয়েছিলেন‌, কি জন্যে ধার চান কিছু বলেছিলেন কি?’

বিশুবাবু বলিলেন‌, ‘তাঁর ইচ্ছে ছিল এখানে কবিরাজী ওষুধের একটা দোকান খোলা। কিন্তু তাঁর মূলধন ছিল না‌, আমার কাছে ধার চেয়েছিলেন। লোকটি গরীব হলেও সজ্জন ছিলেন‌, আমি টাকা দিয়েছিলাম। তিনি বেঁচে থাকলে নিশ্চয় টাকা শোধ দিতেন‌, কিন্তু–! যাকগে‌, ও-কটা টাকার জন্যে আমার দুঃখ নেই। আমি শুধু ভাবছি‌, সদানন্দবাবুর মতো নিরীহ লোককে কে খুন করল? কেন খুন করল? তবে কি তাঁর একটা প্রচ্ছন্ন জীবন ছিল? বাইরে থেকে যা দেখা যেত সেটা তাঁর প্রকৃত স্বরূপ নয়?’

0 Shares